Protisodh - A bengali story

Jolchobi

প্রতিশোধ

বিদিশা মন্ডল

আকাশে তখন রাতের চাঁদ ঘন হয়ে উঠেছে। সুদীপ্ত এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে দেখল নিস্তব্ধ রাস্তায় পাড়ার কুকুরগুলো এলোপাতাড়ি হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। সামনের বাড়ির নারকেল গাছটার পাতাগুলো হাওয়ায় হালকা দুলছে মাঝেমাঝে। চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক।হোম থিয়েটারে নচিকেতার একটা প্রিয় গান চালাল সে-" তুমি আসবে বলেই
আকাশ মেঘলা
বৃষ্টি এখনো হয় নি
তুমি আসবে বলেই
কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঝড়ে যায়নি।
তুমি আসবে বলেই
অন্ধ কানাই বসে আছে গান গায়নি
তুমি আসবে বলেই
চৌরাস্তার পুলিশটা ঘুষ খায়নি।
তুমি আসবে বলেই
জাকির হোসাইন ভুল করে ফেলে তালে
তুমি আসবে বলেই
মুখ্যমন্ত্রী চুমু খেলো স্ত্রীর গালে।
তুমি আসবে বলেই
সোনালী স্বপ্ন ভীড় করে আসে চোখে
তুমি আসবে বলেই
আগামী বলছে দেখতে আসবো তোকে।
তুমি আসবে বলেই..."

শ্রীময়ী কলিং...
-" হ্যাঁ বলো শ্রী।"
-" এখনো ঘুমোয়নি।"
-" ঘুম আসছে না শ্রী।"
-" আবার উল্টোপাল্টা চিন্তা করছ নিশ্চয়।"
-" আমি অনেক ট্রাই করছি কিন্তু পারছি না শ্রী।"
-" এরম করলে হবে না সুদীপ্ত। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলো। কিছু হবে না। সবকিছু ভালো হবে।"
-" আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না।"
-" প্লিজ, এসব কথা বলো না সুদীপ্ত। আমি আছি তো তোমার পাশে। ঘুমিয়ে পরো দেখবে শরীরটা অনেক ফ্রেশ লাগবে।"
-" আচ্ছা আমি চেষ্টা করছি।"
ফোনটা রেখে দিয়ে সুদীপ্ত বিছানায় এলিয়ে দিলো নিজের শরীরটাকে, ঘুম নেমে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাঝরাতে মনে হলো ওর গলাটা চেপে কেউ ধরে রেখেছে, একবার কাশার চেষ্টা করল সুদীপ্ত কিন্তু পারল না। দম আটকে এলো ওর, কেউ ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল -" তোকে মরতেই হবে"। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সুদীপ্ত, সারাশরীর ঘামে ভিজে গেছে। বেডসাইড টেবিল থেকে ও একগ্লাস জল ঢক্‌ঢক্‌ করে খেয়ে নিলো যেন অনেকবছরের পিপাসু। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই সমস্যাটা হচ্ছে সুদীপ্তের। ঘুমের মধ্যে কেউ যেনো ওকে মারতে আসছে আর তারপরই নিশ্বাস আটকে যাবার জোগাড়। ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে সে, কোনকিছুতেই মন বসাতে পারছে না। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় সারাদিন অফিসে কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা আবার রাতে বাড়ি ফিরে ভয়টা জাঁকিয়ে বসছে ওকে কেউ মারতে চাইছে...

বিছানা থেকে উঠে ঘরের লাইটা জ্বালাল সুদীপ্ত, তার টু বিএইচকের ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে। আদি বাড়ি গ্রামে সেখানেই এখন তার বাবা মা থাকে। শহুরে লাইভে অভ্যস্ত সুদীপ্ত গ্রামের বাড়ি খুব একটা যায় না শুধু মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে। ওদের অফিসেই চাকরি করে সুন্দরী শ্রীময়ী, শ্রীময়ী ব্যানার্জী। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে, প্রথম দেখাতেই সুদীপ্ত মনস্থ করে নেয় এই নদীতে তাকে তাকে ছিপ ফেলতেই হবে। এমন একটা ঝক্‌ঝকে মেয়ের অপেক্ষাতেই তো সে ছিল এতোদিন যা গ্রামের সরল মেয়ে তুলিকার মধ্যে কখনই পায়নি সে...

ড্রাইনিং রুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো সুদীপ্ত, হাতে বিয়ারের ক্যান। আকন্ঠ বিয়ার পান করল সে, বেশ নেশাও হয়েছে হঠাৎ ঘরের আবছা আলোয় মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে, চোখের তারারন্ধ্র সংকুচিত করে বোঝার চেষ্টা করল সুদীপ্ত, মুখটা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলো... তু...লি...কা... অষ্পুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ভয়ার্ত আর্তনাদ...

***********
গ্রাম থেকে আসা ছেলেটা যেদিন প্রথম শহরে পা দিলো যেদিনই উঁচু ইমারতের মতো খ্যাতি লাভ করার নেশা চেপে বসেছিল তার মাথায়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই মেধাবী ছাত্র সুদীপ্তই সেরা সর্বকালের জন্য। পড়াশুনার যার সাথে তার টক্কর ছিল সে ছিল তুলিকা বসু, সেও ওর মতো গ্রাম থেকে আগত। বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়েছিল ওদের অচিরেই।মাঝেমাঝেই তুলিকা আর সুদীপ্ত গ্রুপ স্টাডি করত ক্লাসে বসে। সেদিন সব ক্লাস শেষ হবার পর ওরা দুজন ঠিক করে একসাথে কিছু টপিক ডিসকাস করবে। তাই বাকি সবাই চলে গেলেও ওরা থেকে গিয়েছিল। হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, ধরণী শীতল করতে কনজুসি করে না জটলা বাঁধা মেঘগুলো। তুলিকার বাইরে চোখ যেতেই সে পড়াশুনার ইতি জানিয়ে ছুট্টে গিয়েছিল বাইরে করিডরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর স্পর্শ পেতে। সুদীপ্তও ওর পেছনে পেছনে গেলো, তুলিকার প্রনোচ্ছল মুখের তাকিয়ে বলল-" কি রে ভিজবি নাকি?"
-" ভিজলে মন্দ হয়না।"
-" শুভস্র শীঘ্রম।"
দুজনে পায়ের গতি বাড়িয়ে চলে যায় সামনের খোলা মাঠে আকাশের সহচর্যে। তারপর অনেকটা সময় ভিজে হাসতে হাসতে ফিরে আসে ক্লাসরুমে। তুলিকার ভিজে শরীরটা বড়ই আকর্ষণীয় লাগছিল সুদীপ্তের চোখে, ওর ভিজে ঠোঁটের ওম পেতে চাইছিল সে। সুদীপ্তের চোখের দৃষ্টি মিলে গিয়েছিল তুলিকার দৃষ্টির সাথে। লজ্জা পেয়ে তুলিকা বলেছিল-" কিরে ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?"
-" তোকে রে।"
-" কেনো আগে দেখিস নি বুঝি।"
-" এইভাবে দেখিনি রে কোনোদিনো। তোকে খুব মোহময়ী লাগছে রে আজ।"
-" তাই নাকি। ওভাবে তাকাস না প্রেমে পরে যাবি।"
-" প্রেমে পরে গেছি আর কিছু করার নায়।"
এরপর কিছুটা দৃষ্টির মাধ্যমে কথার বিনিময় ঘটে যায় আর ক্লাইম্যাক্সে দুটো ভিজে ঠোঁট মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
এইভাবে কলেজ জীবন পার হয়ে যায় ওদের।ক্যাম্পাসিং এ চাকরিটা পেয়ে যায় সুদীপ্ত ওদিকে তুলিকার বাবা হঠাৎ মারা যাবার পর অসুস্থ মায়ের দেখাশুনোর জন্য গ্রামে ফিরে যেতে হয় তুলিকাকে। যোগাযোগ কমে আসে ওদের মধ্যে। তুলিকা ছোটখাটো চাকরি চেষ্টা করলেও পায় না ওদিকে সংসারের দায়ভার পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পরে সে। এইসময় সে পাশে চায় সুদীপ্তকে কিন্তু পায়না। সুদীপ্ত তখন শহরের রঙিন জীবনে পুরোপুরি সিক্ত, মদ স্যাম্পেনের রঙিন ফোয়ারায় জীবন কাটে তার। অফিসের স্মার্ট শ্রীকে তখন মনে ধরেছে ওর। গ্রামের সরল চুড়িদার পরিহিতা মেয়েটার দিকে এখন সে তাকাবেই বা কেনো? ওর মতে ওটা আদেও প্রেম ছিল না, ছিল ক্ষণিকের ভুল। অন্যদিকে তুলিকাকে ক্রমশ ডিপ্রেশন গ্রাস করে ফেলে, ভালো পড়াশুনা করেও তার ভাগ্যের পরিহাসে আজ সে পুরোপুরি একটা ব্যর্থ মানুষ, কেউ নেয় তার পাশে। ভালবেসে শুধুই মরিচিকার পেছনে ছুটে এসেছে এতোদিন। ডিপ্রেশনের জন্য একের পর এক চাকরির পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছিল তুলিকা। মনের অন্দরে তখন জমা হচ্ছিল সুদীপ্তের প্রতি একটা চাপা আক্রোশ, ও বুঝে গিয়েছিল সুদীপ্ত আর ওর সম্পর্কের মধ্যে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেয়। শ্রীময়ী আর সুদীপ্তের ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরে অবশেষে তুলিকার জমানোর আক্রোশ বেরিয়ে আসে রাগ হিসেবে। সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সে সুদীপ্তকে ফোন করে। অতন্ত বিরক্তির সাথে ফোনটা রিসিভ করে সুদীপ্ত বলে-" বারবার ফোন করে ডিস্টার্ব করিস কেনো? আমিতো বলেছি তোর আর আমার মধ্যে যা ছিল সবটাই শুধু ইনফ্যাচুয়েশন ছাড়া আর কিছুই নয়। তুই ভুলে যা সবটা।"
-" কত সহজে বলে ফেললি না কথাটা। আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোকে ভালবাসলাম আর তুমি অন্য একটা মেয়ের জন্য... ছি... আসলে তুই একটা চরিত্রহীন ছেলে।"
-" এই সাট আপ ওকে। তুমি ইনজয় করিস নি এইসব। রাত গয়ি বাত গয়ি। তোর মতো মেয়ের সাথে ফুর্তি করা যায় বিয়ে করা যায় না ওকে।"
-" ওকে দ্যান দেখ এই মেয়েই কি করে এবার। আমি শ্রীময়ীকে সব বলে দেবো। তোর পুরনো মেসেজ, একসাথে তোলা ছবি এইসব তো আছেই।আমাকে কাঁদিয়ে আমি তোকে কিছুতেই সুখে থাকতে দেবো না।"
-" যা ইচ্ছে তাই করে নে। ফা* ইউ।"

ফোনটা রেখে দেবার পরই সুদীপ্তর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সমাবেশ ঘটতে থাকে। গাঁইয়া সহজ মেয়েটা কি করে এতোটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পরল। তুলিকা যদি সত্যিই সবকিছু বলে দেয় শ্রীকে। না না, ও কোনমতেই হারাতে পারবে না শ্রীময়ীকে। কিছু একটা করতেই হবে সুদীপ্তকে...

কিছুদিন কি করা যায় এইভাবে ভেবেই ভেবেই কেটে যায় সুদীপ্তর। এখনো তুলিকা শ্রীকে কিছু বলেনি। সুদীপ্ত ঠিক করল তুলিকাকে শান্তভাবে সে বোঝাবে সবকিছু। শুধু শুধু জোড় করে একটা মিথ্যে সম্পর্কের মধ্যে আটকা থাকার কোন মানেই হয়না। তাই আলাদা হয়ে যাওয়াই দুতরফের জন্য বেটার। সেইজন্যই সুদীপ্ত তুলিকাকে ফোন করে ওর ফ্ল্যাটে আসতে বলে। সুদীপ্তের ফোন পেয়ে তুলিকা আবার আশায় বুক বাঁধে, ভাবে ওর ভালবাসার জোড়ই সুদীপ্তকে আবার ওর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। সেই উদ্দেশ্যে তুলিকা পাড়ি দেয় সুদীপ্তর ফ্ল্যাটে।

সুদীপ্তর ফ্ল্যাটের ছাদে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে নিরিবিলিতে কথা বলবে বলে। তুলিকায় আব্দার করে খোলা আকাশের নিচে যাবার জন্য। সেই প্রথম দিনের মতো আবার যদি খোলা অনাবৃত আকাশ ওদের প্রেমটাকে আবার সজীব করে। নিস্তব্ধতা ভেঙে সুদীপ্তই প্রথম বলে ওঠে-" দেখ তুলিকা, আজ আমি তোকে এখানে ডেকেছি তার একটাই কারণ যে তোকে আমি সামনাসামনি সত্যিটা বোঝাতে চেয়েছিলাম। আসলে আমাদের মধ্যে কোনদিন ভালবাসা ছিলই না।"
-" কোনটা ভালবাসা ছিলনা সুদীপ্ত। তোক আঁকা প্রথম চুমু নাকি তোর হাতে আমার হাত রাখা নাকি নিজে না খেয়ে তোকে খাওয়াটা। এই সব তবে কি ছিল বল।"
-" উফ সেই এক ঘ্যানঘ্যানে কথাবার্তা। শহরে এতোবছর থেকেও নিজেকে পাল্টাতে পারলি না। এখানে চাদর পাল্টানোর মতো লোকে সম্পর্ক বদলায়, আর তুই সেই চুমুতেই আটকে থেকে গেলি।"
-" হ্যাঁ আমি সম্পর্ক বদলানোর মতো আধুনিক হতে পারিনি। আমার কাছে আজো ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর অনেক দাম। তোরকাছে নাইবা থাকতে পারে তবে আমার কাছে আছে।"
-" তোর মতো মেয়ের সাথে রাত কাটানো যায় কিন্তু ফুলসজ্জা করা যায় না বুঝলি। টিপিক্যাল মিডিলক্লাস সেন্টিমেন্ট। যতসব।"
-" তুই বদলাবি না সুদীপ্ত। এবার আমাকে স্টেপ নিতেই হবে। নাও জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। আমি কি করি।"
চট করে মাথাটা গরম হয়ে যায় সুদীপ্তর। এতো সাহস আসে কোথা থেকে ওর। তুলিকা যখন উল্টোদিকে ঘুরে কথাগুলো বলছে তখন সুদীপ্ত দুটো হাত বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।। শুধু হালকা করে একটু ধাক্কা দিতে হলো তারপর বাকি কাজ হয়ে গেলো। পরেরদিন নিউজপেপারের এককোণার জায়গা নিয়েছিল খবরটি-" অসাবধানতা বসত বহুতল থেকে পরে মৃত্যু তরুণীর"। সুদীপ্ত পুলিশের সামনে নিটল অভিনয় করে কেঁদে কেঁদে জানায়-" আমি আর আমার বান্ধবী কথা বলছিলাম হঠাৎ পা পিছলে ও নিচে পরে যায়, বাঁচানোর সুযোগটুকু পেলাম না। এই পাপের বোঝা আমাকে সারাজীবন বয়ে বেরাতে হবে।" পুলিশ যে ওর সব বিশ্বাস করেছিল তা নয় কিন্তু প্রমাণ আর লোকবলের অভাবে কেসটা ধামাচাপা পরে যায়। তুলিকার চ্যাপ্টার ওখানেই শেষ বলে ধরে নেওয়া হয়...

তারপর কেটে যায় একটা বছর, তুলিকাকে নিজের হাতে খুন করার কিছু মাস পর থেকে সুদীপ্তর মধ্যে একটা চাপা অনুশোচনা কাজ করছিল, শুধু মিথ্যে আতিশয্যের আড়ালে সেটাকে আড়াল করতে রাখতে চাইছিল সে। একজন গ্রামের বোকা ছেলে আজ শহরের রঙিন দুনিয়ায় এসে এতোটা পাল্টে গেলো, মাঝেমাঝে সে একান্তে ভাবে এইসবের কি খুব দরকার ছিল? টাকা, মদ, মেয়ের আসক্তি তার সহজ বোধবুদ্ধিকেও ধ্বংস করে দিয়েছিল। কথায় আছে এই জনমের কর্মফল মানুষকে এই জনমেই পেতে হয় সুদীপ্তর ক্ষেত্রেও তাই হলো। রোজ রাতে সে তুলিকার উপস্থিতি অনুভব করে, ও কি তবে ফিরে এলো প্রতিশোধ নিতে? আত্মাদের প্রতিশোধ নেবার কথা ও শুধু গল্পে শুনেছে সেটা হয়তো বাস্তবে তার জীবনে ঘটবে এবার। তুলিকা ওকে বাঁচতে দেবে না।

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে সুদীপ্ত দেখল সে সোফাতেই শুয়ে আছে, আগের রাতের কথা মনে পরতেই আবার সে ধড়ফড়িয়ে উঠে পরল, হৃৎস্পন্দের হার অনেকটাই বেড়ে গেছে। এইভাবে একটু একটু করে মরণ যন্ত্রণা দিয়েই কি তবে তুলিকা ওকে মারবে। উফ তীব্র বেদনায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ওর। উত্তেজনায় লোমগুলো খাঁড়া হয়ে গেছে, মাথার রগগুলো ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। দুহাত চেপে মাথাটা ধরে তীব্র চিৎকার করে উঠল সে-" আমায় ক্ষমা করে দে তুলিকা, প্লিজ আমাকে মারিস না।"

টিং টং... কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আরেক পরন চমকে উঠল সুদীপ্ত। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। দরজা খুলেই দেখে শ্রীময়ী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল সুদীপ্ত-" ও আমাকে বাঁচতে দেবে না শ্রী, প্লিজ আমাকে বাঁচাও তুমি।"
-" কিচ্ছু হবে না আমি এসে গেছি তো । তুমি অফিসে এলে দেখে আমিই তোমার ফ্ল্যাটে চলে এলাম"- সুদীপ্তর অবস্থা দেখে মোবাইলে শ্রী কল করল ওদের ফ্যামিলি ডক্টরকে...
******
শ্রীময়ীদের ফ্যামিলি ডক্টরের রেফার করা বিখ্যাত সাইকিয়াস্ট্রিট নির্মল চৌধুরীর চেম্বারে বসে শ্রী আর সুদীপ্ত। সুদীপ্ত এক এক করে সমস্তটা উজার করে দেয় ডক্টরের সামনে। শ্রী অবাক হয়ে শোনে সবটা, ওর ভালবাসার মানুষটা এতটা নিষ্ঠুর? ডাক্তারবাবু সমস্ত শোনার পর বলেন- " দেখুন উনার মুখে সবটা শোনার পর যেটুকু বুঝলাম উনি এখন " থানাটোফোবিয়া" অর্থাৎ মৃত্যুভয়ের পেসেন্ট। তুলিকাকে খুন করার পর থেকেই উনার মধ্যে অনুশোচনার আগুন জ্বলে উঠেছিল সেই অনুশোচনা থেকেই তিনি ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে যান আর সেখান থেকেই তিনি প্রতিরাতে হ্যালুসিনেশনের দরুন উনার পুরনো প্রেমিকাকে দেখতে পেতেন যা পুরোটাই উনার কল্পনা। এই কল্পনা থেকেই উনি ভেবে নেন তুলিকা ওকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিতে এসেছে আর সেই থেকেই তিনি এই এই ফোবিয়ার আক্রান্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে পেসেন্টকে বের করতে একটা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।"

শ্রীময়ী সবটা ধৈর্য ধরে শোনার পর বলে-" ও যে অপরাধ করেছে সেটার জন্য ওকে শাস্তিও পেতে হবে, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি, উনারা যা ভালো বুঝবেন সেটাই ঠিক করবেন।"- শ্রীময়ী নিজেকে শক্ত করে নেয়, যে মানুষটাকে সে ভালবেসেছিল সে একটা খুনি তাই তাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠেনা। সে কিছুতেই দুর্বল হবে না। আজ যদি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ সে না করে তাহলে নিজের বিবেক দংশনের সে মরে যাবে। তাই চোয়াল শক্ত করে শ্রীময়ী পুলিশকে ফোন করে।

পুলিশ আসার পরও সুদীপ্ত একইভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জানায় আপাতত তাদের আন্ডারেই চিকিৎসা হবে সুদীপ্ত তারপর পুরোপুরি সুস্থ হলে কোর্টে তার বিচার হবে। অবশ্য শাস্তি তো সুদীপ্ত প্রতিদিনই পাচ্ছে, অনুশোচনার আগুনে ওর শরীরটা পুড়ছে প্রতি মুহূর্ত। আজ শুধুমাত্র ওর লোভ, রঙিন কিছু মেকি মোহের জন্য তিনটে মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেলো।। যাবার সময় সুদীপ্ত নিশ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্রীময়ীর দিকে, হয়তো সেই দৃষ্টি বলতে চাইছে-" পারলে আমায় ক্ষমা করো শ্রী..."। আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চোয়াল শক্ত করল শ্রীময়ী। না কিছুতেই দুর্বল হবে না সে..

সমাপ্ত

© FB.com/profile.php?id=100008522163284



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~