Backstage - A bengali story

Jolchobi

ব্যাকস্টেজ

অর্পিতা মন্ডল

ঠেকবাজি করে বাড়ি ফিরতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে।এমনিতেই বর্ষার রাত তার উপর আবার লোডশেডিং। আধ হাত দূরের মানুষকেই দেখা যাচ্ছেনা ভাল করে।ঝিরঝিরে বৃষ্টির ছিটে চশমার কাঁচটাকেও ঝাপসা করে দিচ্ছে। কোনরকমে এক হাতে ছাতা ধরে বেশ জোরে প্যাডেল করে ফিরছি হঠাৎ পেছন থেকে ডাক------

------"অমিত"-----

থমকে দাঁড়ালাম,একি!জয়ন্তর গলা না!সাইকেল থামিয়ে মোবাইলের ফ্লাশটা অন করতেই দেখি হ্যাঁ,যা ভেবেছি ঠিক তাই। মালটা তাহলে বাড়ি যায়নি।

-"কি রে?তুই কোত্থেকে টপকালি!তোর না বাড়ি যাওয়ার কথা!"
-"নারে, মা বাবা গিয়েছে মেজপিসির বাড়ি,কালনায়। পিসেমশাই এর শরীর খারাপ। আমায় তাই এখানেই থেকে যেতে হল।"
-"তা অভিজিৎ, সঞ্জয় ওরা তো বাড়ি গিয়েছে। তুই মেসে তাহলে একা?"
-"আমায় বাঁচা ভাই,আমি একা থাকতে পারছিনা। ঐ মেসে ভূত আছে।"
-"এক চাঁটি মারব, ভীতুর ডিম কোথাকার। " -"নারে, সত্যি বলছি, রাতে কারা সব মেসের ছাদে পায়চারি করে, জানলা দিয়ে হাত বাড়ায়।কাল রাতে একা ছিলাম, সারা রাত জেগে বসেছিলাম। আজকের রাতটা উতরে দে,মা বাবা ফিরলে কালকেই আমি বাড়ি চলে যাব। "


আমাদের এই মফস্বলের কলেজটায় হোস্টেল না থাকায় অনেককেই মেসে থেকে পড়াশুনো করতে হয়। অভিজিৎ, সঞ্জয় আর জয়ন্তও সেরকমই একখানা এককামরার মেসে থাকে আর ওরাই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমাদের চারজনকে চেনেনা এমন লোক কলেজে খুব কমই আছে। জয়ন্তটা পড়াশুনোয় ভাল হলেও ভূতপ্রেতে ওর অগাধ আস্থা। ওর বক্তব্য -আমাদের চেনা জগতের বাইরেও আরেকটা দুনিয়া আছে,তাকে নাকি ও অনুভব করতে পারে আর এই অনুভবই যত নষ্টের গোড়া। যতই আমরা বোঝাইনা কেন সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়ে এমন কথা বললে লোকে হাসবে,খিল্লি করবে কিন্তু ওর বিশ্বাসকে টলাতে পারিনি আজও।সারাদিন ভূত নিয়ে আজগুবি কথা বলবে আর রাত হলেই ভূতের ভয়ে মরবে।একদিন তো মাঝরাতে ভূতের ভয়ে নিজের চৌকি ছেড়ে অভিজিৎ এর চৌকিতে আস্তানা গেড়েছিল।তারপর আমাদের কাছে গাঁট্টাও খেয়েছিল যথারীতি। ও নাকি ভূত দেখতে পায় আর ওর দাবি আমাদেরকে ও নাকি একদিন ভূত দেখিয়ে তবে ছাড়বে।

টার্ম এন্ডে ওদের তিনজনেরই বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল গতকাল। জয়ন্ত যায়নি দেখে আমার বেশ ভালই লাগল।এতগুলো দিন ওদেরকে ছেড়ে থাকতে আমার মোটেই ভাল লাগতনা।কানুদার ঠেকে অনেকেই আসে কিন্তু ওরা না থাকলে যেন ঠিক জমেনা। যাইহোক জয়ন্ত আমাকে কথা দিল যে আজ রাতে ও আমাকে ভূত দেখাবেই। ছোটবেলা থেকেই আমার আবার এই বিষয়টাতে প্রবল অবিশ্বাস। যা চোখে দেখতে পাইনা,কানে শুনতে পাইনা তাকে বিশ্বাস করা আমার ধাতে নেই। তবু বন্ধুকে মেসে একা রাত কাটাতে দিতে ইচ্ছে করলনা।আমাদের বাড়িতে এসে থাকতে বলায় ও সে কিছুতেই রাজি হলনা। আমাকে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে মেসে আসতে বলে চলে গেল। বাড়ি ঢুকতেই কারেন্টাও চলে এল।
রাত তখন এগারোটা হবে,মেসের গেটের সামনে আসতেই কড়কড়কড়াৎ করে খুব কাছে একটা বাজ পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে আবার লোডশেডিং।
সেইমূহুর্তেই জয়ন্ত দরজা খুলে দিল।

-"তোকে না আসতে বললেই ভাল করতাম।শুধু শুধু ঝড়বৃষ্টিতে আবার এলি।কালকের মত আজও নাহয় কোনমতে কাটিয়ে দিতাম।ভুলই হল।"
-"নিজে ডেকে আবার ঢং করা হচ্ছে!নিজে মরছে ভূতের ভয়ে আবার বড় বড় কথা!নাটুকেপনার আর শেষ নেই!সর তো সর"---বলে ঘরে ঢুকে পড়লাম।

এ ঘর আমার অপরিচিত নয় একেবারেই।গিয়ে বসলাম একটা চৌকির উপর। জয়ন্ত একটা মোমবাতি জ্বালালো।বাইরে বৃষ্টির তোড় যেন বেড়েই চলেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেঘের গর্জন।বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসে মোমবাতির আলো কাঁপছে আর তার সাথে ঘরময় অদ্ভুত এক আলোআঁধারি তৈরী হচ্ছে। মেসবাড়িটা এমনিতেই পুরনো, জানলা দরজাগুলো লড়ঝড় করছে। বাইরের ঝড়ের দাপটে জানলার পাল্লাগুলোয় ঠোকাঠুকি লেগে খটাখট আওয়াজ হতেই জয়ন্ত হাউমাউ করে আমার প্রায় ঘাড়ে এসে পড়ল। -"ওরে বাবারে,ভূত ভেতরে আসতে চাইছে রে,এবার কি করব?"
-"ভূতের বাবার শ্রাদ্ধ করব রে হতভাগা"---বলে এক ধমক দিতে ও ধপাস করে আমার পাশে বসে পড়ল।
-"তুই মানছিস না তো!এর প্রমান ঠিক তুই পাবি।আমি প্রমান করবই"---
জয়ন্তর চোখেমুখে একটা দুঃখ মেশানো ভয় রয়েছে যেটা এই অল্প আলোয়ও আমার নজর এড়ালো না।এরপর ঠিক হল আজ সারারাত আমরা জেগে থাকব আর জয়ন্ত আমাকে ভূত দেখাবে।
কিছুক্ষণ পর আমার মাথায় একটা বদবুদ্ধি খেলে গেল। জয়ন্তর বাথরুমে যাওয়ার সুযোগে মোমবাতিটা দিলাম নিভিয়ে।বাথরুমের দরজার পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।যেই না ও বেরিয়েছে ওমনি আমি ওর কানের কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বললাম---"তোর বন্ধু অমিতকে আমি মেরে ফেলেছি"---সাথে সাথে ও ভয়ের চোটে চিৎকার করে আমায় এমন ঝটকা মারল যে আমি সোজা গিয়ে পড়লাম টেবিলের উপর।তাড়াতাড়ি বললাম---"ওরে আমি ভূত না রে,আমি মানুষ, অমিত"।ততক্ষণে জয়ন্ত ওর চৌকির ওপারে লাফ দিয়েছে।আমি কোনরকমে উঠে মোমবাতিখানা আবার জ্বালিয়ে দিলাম।দেখি,ও দূরে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।কিছুক্ষণ পর আমায় প্রানভরে গাল দিয়ে আমার কাছে এল আর আমিও কান মললাম যে এই হদ্দ ভীতুরামকে আর কোনদিনও ভয় দেখাবনা। হঠাৎ মেসের ঠিক পাশ থেকেই একটা কুকুর ডেকে উঠল। সুরটা যেন কানে তেমন ভাল ঠেকলনা। জয়ন্ত বলল কুকুরের এই ডাকটা নাকি খুব অশুভ,তার মানে আশেপাশেই কোথাও ভূত আছে।তারপর রাত আড়াইটে তিনটে পর্যন্ত----"ঐ যে জানলায় কার কালো হাত","ঐ যে দেওয়ালে কার ছায়া চলে গেল"--এমন বিভিন্ন উক্তি আর তার সাথে আমার গালি হজম করে ক্লান্ত হয়ে ওর চৌকিতে শুয়ে পড়ল।তারপর শুয়ে শুয়ে কোন কোন লক্ষণ থাকলে তবে সেখানে তেঁনাদের অস্তিত্ব আছে বুঝব সেইসমস্ত বর্ণনা দিতে লাগল আর আমি সেসব শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তাও ঠিক মনে নেই।

চোখের উপর সকালের রোদ এসে পড়ায় যখন ঘুম ভাঙল তখন বুঝলাম যে ক'দিনের নিম্নচাপের ঘোর কেটে আজ আকাশ পরিষ্কার। জানলার পর্দাটা সরানোই ছিল,কাঁচের মধ্যে দিয়েই আলো ঢুকছে,উঠে এলাম,খুলে দিলাম জানলা। কাল রাতের ঝড়বৃষ্টির তান্ডবের ছাপ স্পষ্ট পুরো বাগান জুড়ে।

ক্রিরিরিং......ক্রিরিরিং..........

আমার মোবাইলটা বাজছে
বাব্বা এত সকালে সঞ্জয়ের ফোন!ফোন রিসিভ করতেই-----
--"হ্যালো হ্যালো অমিত?
শুনতে পাচ্ছিস?
অমিত?
সর্বনাশ হয়ে গেছে----
---অমিত---
কাল দুপুরে--বাড়ি যেতে গিয়ে বাজ পড়ে---
--জয়ন্ত আর নেই রে---"

পা দুটো মনে হল গাছ হয়ে গেছে। ঐ চৌকিটা ফাঁকা,বাথরমের দরজা খোলা, কোনমতে ছুটলাম বারান্দার এদিক থেকে ওদিক, না কেউ কোত্থাও নেই। আমি ছুটছি বাগান পেরিয়ে------
শুনতে পাচ্ছি কানে কানে কে যেন বলছে---"আমরা যা দেখছি,শুনছি শুধু সেটুকুই সত্যি নয়,এ জগতের বাইরেও আরেকটা দুনিয়া আছে"।

ছুটছি, ছুটছি, ছুটে চলেছি
কতক্ষণ এভাবে ছুটেছি মনে নেই। জ্ঞান যখন এল---

একি!কোথায় আমি!এ জায়গায় আমি এলাম কি করে!এ যে একেবারে অচেনা জায়গা!সন্ধ্যেও তো হয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। ঐ তো অভিজিৎ আর সঞ্জয়। বাবাও রয়েছে দেখছি।যাক বাবা প্রানে বল পেলাম। ওদের বলতে হবে কাল রাতের কথা। এগিয়ে গেলাম----

অভিজিৎ --"এখানে আর থাকবনা রে,অসম্ভব। আমরা দুজন ঐ মেসে কি করে থাকব!সবথেকে বড় কথা আমরা কেউ নেই জেনেও অমিত কেন কাল রাতে মেসে যেতে গেল!ইস যদি না যেত, তাহলে----"

সঞ্জয়--"তবে আজ সকালে অমিতের ফোনটা রিসিভ করল কে!কোন আওয়াজ ও তো পেলামনা। আমি জয়ন্তর খবরটাও দিলাম। তখন কি করে বুঝব, জয়ন্তর মত অমিতও-----
শুধু একটা দিন আগে আর পরে,শুধু জায়গাদুটো আলাদা।অমিতটা মেসের গেটে----
উফফ আর ভাবতে পারছিনা--"
অভিজিৎ --"তুই ভুল করছিস সঞ্জয়, ফোনটা কেউ আদৌ রিসিভ করেনি,তোর মাথার ঠিক ছিলনা। কি বুঝতে কি বুঝেছিস তার ঠিক নেই। ছিলাম চারজন, হয়ে গেলাম দুজন।এখানে আর না রে,এখানে আর না।"

কিসব আবোলতাবোল বকছে ওরা!পাগল হয়ে গেল নাকি!
একি!একি!এত তাপ লাগছে কেন?
একি!একি!ও কে!
কাঠের ওপরে শুয়ে ও কে!
আমি!আমি!মানে!

কাঁধে কারো হাত পড়ল। চমকে উঠলাম।জয়ন্ত পাশে দাঁড়িয়ে, চোখে জল।
--"বলেছিলাম না অমিত---
এ দুনিয়ার পরেও আরেকটা---
তবে এভাবে প্রমান দেব, আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি রে ভাই"---

সমাপ্ত

© FB.com/arpita.mandal.1420



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~