Bajilo Kahar Bina - A bengali story

Jolchobi

বাজিলো কাহার বীণা

ঋতুপর্ণা রুদ্র



বিভাসবাবু আজ সকাল থেকেই ভিতরে ভিতরে টেনশনে আছেন। একেই রক্তচাপ বেশি তার উপরে মেজাজি মানুষ, ফলত বেশ কয়েকজন বকুনি খেয়েছে তার কাছে। আসলে কাজে ফাঁকি দেওয়া আর সময় মত কাজ না হলেই মেজাজটা গরম হয়ে ওঠে আর কি। এই যেমন গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে বেরোবে ঠিক সকাল সাড়ে এগারোটায়, দশটার মধ্যে মিষ্টি আসার কথা। এই অঞ্চলের বিখ্যাত দোকান দোলগোবিন্দতেই মিষ্টির অর্ডার দেওয়া। তা দশটা বেজে গেলো মিষ্টি দেবার নাম নেই, বেশ দুচারবার ফোন করার পরে মিষ্টি নিয়ে যে এলো সে দোষের মধ্যে বলেছিলো আপনারা এগারোটায় বেরোবেন, তার আগে তো এনেই দিয়েছি, অমনি বিভাসবাবু তাকে সময়ানুবর্তিতা নিয়ে ছোটখাটো ভাষণ দিয়ে ফেললেন। বেগতিক দেখে বড় ছেলে "বাবা এদিকে শোনো, একটা কাজ আছে" বলে তাকে সরিয়ে নেয়।

এদিকটা মিটতে না মিটতেই খেয়াল করলেন ফুল দিয়ে যার বাড়ি সাজানোর কথা সে বেশি লোক এনে ঘন্টা দু এক এর মধ্যে পুরো তিনতলা বাড়িটা সাজিয়ে দেবে বললেও এসেছে দুটো মাত্র লোক তারা কাজ করছে কম উলটে মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এই যখন তখন হাটে বাজারে রাস্তায় হাঁহাঁ করে ছবি তোলাটা বিভাস দুচক্ষে দেখতে পারেন না। ছবি তোলাটা তার কাছে কেমন ন্যাকামো মনে হয়। খাও দাও কাজ করো এত ছবি তোলার কি আছে। বিভাস নিজে কখনওই ছবি তোলেন না। মাএর কোলে দু এক খানা, কটা পাসপোর্ট ছবি আর বিয়ের পরে দুটো এই তার মোট ছবির তালিকা।

সুতরাং কাজে দেরির জন্য ফুলের লোকেরা যখন একপ্রস্থ বকুনি খাচ্ছে তখন তার ছোট বোন শোভা এসে "দাদা চা খাবে না সরবৎ, এসো না একটু বিশ্রাম নাও" ইত্যাদি বলে তাকে নিয়ে এলো দোতলার দক্ষিণের বড় ঘরটাতে। ঢুকেই দেখলেন আজ যার বিয়ে সেই শিবু ওরফে শিবপ্রসাদ একটা ধুতি পরে হাসি হাসি মুখে মোবাইলে কি যেন দেখছে আর তার গিন্নি সারদা এক থালা লুচি আলুর দম, আর সরবত নিয়ে ছেলেকে খাওয়ানোর উদ্যোগ করছে। দৃশ্যটা দেখেই বিভাস বাবুর পিত্তি জ্বলে গেলো। তিনি বাজখাঁই গলায় হেঁকে বললেন

"সারদা তোমার কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো মনে পড়ে?"

সারদার স্বভাবটা যে মা সারদার মত নরম এমন নয় তিনি যথেষ্ট জাঁদরেল, তবে এই সংসারে বিভাসবাবুকে ভয় পায় না এমন কেউ নেই। বিশেষত এই দুষ্কর্মটি বিভাসবাবু হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন। সারদার রাগটা গিয়ে পড়লো ননদ শোভার ওপরে, তবে মুখে তিনি হার মানার পাত্রী নন, একটু জোরেই জানান দিলেন "সে কবেকারের কথা আমার অত মনে নেইকো।"

"না মনে থাকলে মনে করিয়ে দিই, তখন তোমার বয়স ছিলো উনিশ। তা বলি সেই বিয়ে দিন সকাল থেকে কি কি খেয়েছিলে বলোতো। আর জবাব করতে হবে না, জানি সেদিন কিছুই খাওনি, আমার বয়স ছিলো পঁচিশ আমিও কিছু খাইনি। বিয়ের দিনটা উপোস থেকে পবিত্র চিত্তে হোম করবে, যজ্ঞ করবে একটা মেয়ের দায়িত্ব নেবে আর তুমি এই আঠাশ বছরের ধাড়ি ছেলেকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছো, বলি তোমার আক্কেলটা কি?"

"বিয়ের দিনে ছেলেটাকে বয়স নিয়ে টুকোনা তো, কেমন বাপ বুঝিনা।" সারদার চোখের কোণে একটু জলের আভাস দেখে বিভাস অপ্রতিভ হয়ে
"এই যে শিবু, তুমি খেয়ে নাও এরপর তুমি না খেয়ে শরীর খারাপ করলে তোমার মাজননী আমাকেই দোষী ঠাওরাবেন কিনা" বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। সারদাও ছেলের মুখে লুচি তুলে দেন।

বিভাস বাবু এখনও পুরোনো দিনের নিয়ম কানুন মেনে চলতে ভালোবাসেন। হাওড়ায় কালিবাবুর বাজারের কাছে তার বড় কারখানা, প্রায় জনা পঁচিশ কর্মী নিরলস কাজ করে, বাপ দাদার আমলের ব্যবসাটাকে তিনি বাড়িয়েছেন, এই অঞ্চলের কত কারখানা যখন বন্ধ হয়ে গেছে তার কালীমাতা প্রা লি: এখনও দৌড়চ্ছে। আসলে তিনি বাবু হয়ে ওঠেননি, উলটে ক্রেতাদের বাবু ডাকতে তার দ্বিধা নেই। কাস্টমার ভগবানের রূপ, তার বাবার শেখানো এই কথাটিতে তিনি বিশ্বাস রাখেন। তাঁর বড় দুই ছেলে সুমন আর অভীকও বিবাহিত,সুমন বাবার সাথে ব্যবসা দেখে আর অভীক ডাক্তার। বিভাসবাবু প্রেম ভালোবাসা করে বিয়ে করায় বিশ্বাসী নন, বাপ মা দেখে বিয়ে দিক তারপর যত খুশি ভালোবাসো এই হোল তার মত। সেই ভাবেই দুই ছেলেরই তিনি নিজে দেখে বিয়ে দিয়েছেন তবে ওই আর কি তার মধ্যে একটু গল্প আছে।

সুমনের বৌ রূপকথা হোল এই পরিবারের প্রাণভোমরা, সবাইকে নিয়ে চলতে ভালোবাসে, নতুন বিয়ের পরদিনই সে সারদাকে তার বৌভাতে বিঊটি পার্লারে নিয়ে যায়, বিভাস বাবুও রূপকথাকে খুব ভালোবাসেন। রূপকথা ব্যাংকে চাকরি করে। বিভাস বাবু মেয়েদের লেখাপড়া শেখা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোকে মনে করেন খুব জরুরী। তা একদিন অভীক এসে বৌদিকে ধরে পড়লো। তার চেম্বারে পিসিকে দেখাতে একটি মেয়ে নিয়মিত আসে, বলতে কি একটু বেশি ঘনঘন আসে, অভীক সেই মেয়েটির প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে একে তো প্রেম তারপর অন্য জাত, সব মিলিয়ে এখন সে কি করবে বুঝতে পারছে না। এই নিয়ে বিভাসবাবু যে কি গণ্ডগোল করবেন কে জানে ভেবে রূপকথা কূল কিনারা পায় না।

"হ্যাঁ রে অভি মেয়েটির বাড়িতে মেনে নিয়েছে? কে কে আছে বাড়িতে?"
অভীক মাথা নাড়ে, "ওর মা মারা গেছিলেন ছোটবেলায়, মানুষ হয়েছে পিসি আর কাকার কাছে দুজনেই অবিবাহিত। দু বছর আগে বাবাও মারা গেছেন। ওদের বাড়িতে সমস্যা হবে না।"

"কি পড়াশোনা করছে?"

"গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, মাস্টার্স করারও ইচ্ছে।"
রূপকথার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, "দাঁড়া দেখছি কি করা যায়!"

বৌমণির অভয়বাণীতে আশ্বস্ত হয়ে অভীকও নিশ্চিন্তে কাজে রওনা হয়।

এমনিতে দাস বাড়িতে রাতের খাওয়া একসাথেই সারা হয় তবে কদিন থেকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য সাড়ে আটটার মধ্যেই বিভাস বাবু খেয়ে নিচ্ছেন। পুরনো কাজের লোক সন্ধ্যা খাবার বেড়ে দেয়। সারদা পাশে বসে তত্ত্বাবধান করেন। অন্যদিন এইসময়ে রূপকথা তার পাঁচ বছরের মেয়ের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আজ শ্বশুরের খাওয়ার সময়ে এসে বসলো।

"ও মা, তুমি যাও, আমি বাবার কাছে আছি। তোমার টিভিতে দেখো সিরিয়াল হয়ে গেলো।"

সারদা যারপরনাই খুশি হয়ে টিভির ঘরে চলে গেলেন। রূপকথা শ্বশুরকে এটা ওটা খাবারের কথা বলছে কিন্তু মুখ শুকনো, বিভাস নজর করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। পরদিন আবার রূপকথা তার খাবার বেড়ে ডাকলো,আজ সারদা খাবার ঘরে উপস্থিতই নেই।

ডাল ভাত শেষ করে, শেষ পাতে দুধ ভাত মাখতে মাখতে বিভাস বলেই ফেলেন

"ব্যাপার কি বৌমা কদিন থেকেই দেখছি চুপচাপ, কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?"

রূপুর মুখ আরো করুণ হয়ে ওঠে।

"আমার এক বন্ধুর বোন, জানেন বাবা, লেখাপড়ায় খুব ভালো, মাস্টার্স করতে চায়, কিন্তু আর বোধহয় পড়াশোনা করতে পারবে না, তার জন্যই মনটা খুব খারাপ।"

"সে কি পারবে না কেন?"

"আসলে ওরা থাকে সেই কল্যাণী, এদিকে ওর পড়ার ইচ্ছে কলকাতায়, বাড়িতে কেউ রাজী হচ্ছে না। ওর বাবা মা নেই, পিসি আর কাকার কাছে থাকে, তারা এতদূর যাওয়া আসার অনুমতি দিচ্ছেন না। এই আর কি।"

চিন্তা করতে থাকেন বিভাস, দুধ ভাত শেষ করেও কিছুক্ষণ তারপরে উঠে যান।

পরদিন রূপকথা অফিসে বেরোচ্ছে, বিভাস ডেকে পাঠান,

"আচ্ছা বৌমা তোমার আক্কেলটা কি, কাল যে বললে তোমার বন্ধুর বোনের সমস্যা, তা তুমি ওকে আমাদের বাড়িতে থাকতে বললেই তো পারো। দুবছরের তো ব্যাপার, এখানে থাকবে খাবে ইউনিভার্সিটি যাবে, কোনও অসুবিধাই হবে না। এটা তো তোমার মাথায় আসা উচিৎ ছিলো, কি যে করো কে জানে, মাথায় কি গোবর আছে!"

বকুনি খেলেও মনে মনে নেচে ওঠে রূপু, ঘটনা একদম তার মনের মত এগোচ্ছে।

"ঠিক কথা বাবা, আসলে আমার মাথায় আসেনি, আজই বলে দেখছি।"

রাতে খাবার বাড়ার সময় তার আবারো ম্লান মুখ,

"বাবা, ওদের বাড়িতে রাজি হচ্ছে না, আসলে অবিবাহিত মেয়ে, এই বাড়িতে থাকবে, ওর পিসির মত নেই।" বিভাস ভেবে দেখেন, সত্যি তারা রাজি না হতেই পারে।। কি আর করা যাবে!

"আচ্ছা বাবা" রূপকথার মুখে হঠাৎ আলো, "একটা কাজ করলে হয় না?"

"কি কাজ বলো?"

"বলছিলাম অভির তো বিয়ে দেওয়া দরকার এবার, মাও বলছিলেন সেদিন, তা এই শমিতার সাথে বিয়ে দিলে কেমন হয়? মেয়েটা বেশ ভালো, অভির সাথে মানাবে তারপরে এখানে থেকে পড়াশোনাও করতে পারবে। আপনি কি বলেন?"

বিভাস খুশিই হন। "তা বেশ তো, তবে বিয়ে তো আর এক কথার জিনিস না, তোমার মাকে বলো, মেয়ের বাড়িতে যদি রাজি হয়, আমার আপত্তি নেই, তোমার পছন্দ যখন মেয়ে ভালো হবে এ বিশ্বাস আছে আমার।"

রূপকথা মনে মনে ভাবে শমিতা বলে মেয়েটিকে সে জীবনে চোখেই দেখেনি আর উনি তাকে কত বিশ্বাস করেন। তার তিন মাসের মধ্যে শমি এই বাড়ির মেজ বৌ হয়ে আসে বর্তমানে সে মাস্টার ডিগ্রি শেষ করেছে।



শিবুর একটা ইতিহাস আছে। আজ নতুন করে বিভাসের সেটা মনে পড়লো। কিছু মানুষের মিষ্টি কথাও কখনও গায়ে বেঁধে। দিন কয়েক আগে বিভাস কাগজে দেখলেন সরকারি হোমের একটি মেয়ের সাথে একজন মহিলা তার ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন। দেখেই ভাবলেন এটা তো বেশ ভালো একটা কাজ, দুজনের তো হয়েই গেছে, বাকি আছে শিবু, তার সাথে একটি অনাথ হোমের মেয়ের বিয়ে দিলে কেমন হয়। বাড়িতে সবাই বেশ খুশিই হোলো, বিভাস বাবু উদ্যোগী মানুষ। পরদিনই যোগাযোগ করে কথাবার্তা সেরে ফেললেন। তারপরে বেশ কয়েকবার হোমে যাতায়াত, পছন্দ হোলো মানসী নামের একটি মেয়েকে। সতেরো বছর বয়স থেকে হোমে আছে, উচ্চ মাধ্যমিক পাস। ভালো সেলাই জানে। বর্তমানে হোমের মেয়েদের সেলাই দিদিমণি।

বিভাস বাবুর খুব মায়া পড়ে গেলো, তিনি ঠিক করে নিলেন মানসীকে তিনি একতলার একটি ঘরে ‘সেলাই ঘর’ বলে টেলরিং শপ খুলে দেবেন কারণ তার মতে ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’। বাড়ির অন্যরাও শুনে বেশ সন্তোষ প্রকাশ করলো, সারদা বললো "সে বেশ ভালো কথা এবার থেকে ছোট বৌমা ব্লাউজ, সায়াগুলো বানিয়ে দিতে পারবে। এই কবিতা টেলার্স ছ্যা ছ্যা, পয়সা নিস আমার থেকে আর জামা বানাস কার মাপে কে জানে। প্রতিবার অল্টার করে করে জান কয়লা হয়ে গেলো।"

অন্য সবাই বেশ মতে মত দিলো শুধু রূপকথা হাঁহাঁ করে উঠলো

"কি যে বলেন বাবা, এখনকার দিনে ওই সেলাই ঘর টর চলে না!"

বিভাস বাবু গম্ভীর, "তা কি চলে শুনি"

"বুটিক, নানা ধরণের বানানো জামা তাছাড়া রেডিমেডও থাকবে, মা শুধু সায়া ব্লাউজ নয়, শাড়িও থাকবে বুঝলে, নাম হবে মানসী’স বুটিক।"

হেসে ফেলেন বিভাস, রূপুর মনটা বড় ভালো, "তা বেশ তো আমি অত বুঝি না, বুটিক না কি বললে সেইটাই হবে ক্ষণ, আমি কিছু দেবো, তাছাড়া হাওড়া গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নেবে, সে ব্যবস্থা করে দেবো।"

বিভাসের হাসি দেখে সবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে, রুপু পারেও বটে, এবাড়িতে বিভাসের মুখের ওপরে কথা খুব বেশি লোকের বলার সাহস নেই।

তা সেই শিবুর বিয়েতে এসেছেন সুকান্ত ঘোষ, একসময় কাছাকাছি থাকতেন এই পাড়ায়, এখন রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন। সরকারি চাকুরে ছিলেন, কথাবার্তায় হামবড়া ভাব দেখান বলে কোনদিনই লোকটাকে পছন্দ হয় না বিভাসের কিন্তু সুকান্তর গিন্নি রাধিকা সারদার প্রাণের বন্ধু, দুজনে আবার আদ্যিকালের মত সই পাতিয়ে রেখেছে ফলে সারদার ছোট ছেলের বিয়েতে তারা সপরিবারে সকাল থেকেই হাজির।

দুপুরে সবার খাওয়ার পরে একটা পান মুখে বারান্দায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন বিভাস, পাশে পরিতোষ তার ম্যানেজার। বরযাত্রী নিয়ে বেরোবেন ছটার পরে, লিলুয়া যেতে ঘণ্টা খানেকও লাগবে না। হোমের মেয়ের বিয়েতে সরকারি সাহায্য এসেছে, খাওয়ার মেনু নাকি ভালোই, জেলাশাসক থেকে পুলিশ কর্তা সবাই বিয়েতে সামিল, না শিবুটার কপাল ভালো এই সব ভাবছেন, এমন সময় মুখে মধুর হাসি এনে পাশে এসে বসলেন সুকান্ত ঘোষ।

"আপনার বুদ্ধিটা কিন্তু জব্বর, শিবু হোল আপনার পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা তার সাথে সম্বন্ধ করে ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে দেওয়া মুশকিল ছিলো তা এই হোম টোম খুঁজে ভালোই করেছেন, পাত্র পাত্রী দুজনেরই জাত গোত্র নেই, বেড়ে বুদ্ধি আপনার হাহাহা।"

কথাটা শুনে বিভাসের কান থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগলো, কি বলছে এই লোকটা, তার শিবুর জাত গোত্র নেই। তাঁর মুখের ভাব দেখে পরিতোষ প্রমাদ গুনলো কর্তাকে সে বহুকাল ধরে চেনে, তাড়াতাড়ি উঠে এসে সুকান্তর হাত ধরে উঠিয়ে বললো "কি যে বলেন, এমন বলতে আছে? চলুন বৌদি বোধহয় আপনাকে খুঁজছেন" কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলোনা।

বিভাসবাবু বাঘের মত হুংকার দিলেন, "আপনার এত বড় সাহস আপনি শিবু আর মানসীর জাত গোত্র তুলে কথা বললেন, আপনার জাত গোত্র জানতে আমার বাকি নেই, সরকারী চাকরিতে দেদার ঘুষ খেয়ে রাজারহাটে বাড়ি বানিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, কি ভেবেছেন কি যা খুশি বলবেন?"

বাড়ি শুদ্ধ সবাই যখন চিৎকার শুনে ছুটে এলো ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। সুকান্ত ঘোষ চেঁচিয়ে ডাকছেন "রাধিকা, বাড়ি চলো এখানে আর থাকবো না, ডেকে এনে অপমান, কিরকম লোক এরা!"

বিভাস তাল ঠুকছেন "যান যান অপমান আপনি করেছেন আমার শিবুকে, আমি কিছুই বলতে চাইনি।"

সারদার চোখে জল এলো দেখো দিকিনি কর্তার কাণ্ড এই রাগ আর মেজাজ আর কত সহ্য করবেন, আজ বিয়ে বাড়িতেও রাগ করে অতিথির অপমান হোল, তখন হাল ধরলেন রাধিকা।

"বিভাস দাদা আপনি মনে কিছু করবেন না, আমার কর্তার হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম, সই কাঁদিসনি তো, সারাজীবন আমি যে কাকে নিয়ে ঘর করলাম আমিই জানি। তুমি এই মুহূর্তে বিভাস দাদার কাছে ক্ষমা চাও, চাও বলছি।" আরও কিছু কথাবার্তার পরে দুপক্ষই একটু নরম হয়ে পরস্পরের সাথে হাত মেলালো।
তৈরি হয়ে ছটা নাগাদ সবাই মিলে বেরোনোও হোল।

গাড়িতে বিভাস চুপ করে বসে রইলেন পাশে শিবু, মনে মনে বিভাস মরমে মরে আছেন, আজ এই বিশেষ দিনটাতেও ছেলেটাকে এই সব কথা শুনতে হোল। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে কুলটি গেছিলেন বিভাস একটা কাজে, সারাদিন কাজ সেরে সন্ধ্যের গাড়িতে ফেরা। ছোট স্টেশন, গাড়ি আসতে তখনও আধ ঘন্টা দেরি, চা আর ডিম টোস্ট কিনে সবে বেঞ্চিতে বসেছেন, দেখেন একটা ছোট বাচ্চা বছর তিনেক বয়স, ভালো কিন্তু ময়লা জামা কাপড় পরে বসে আছে। তার হাতের খাবারের দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে হাত বাড়াচ্ছে।

"খোকা তোমার নাম কি? তোমার সাথে কে আছে?"

বিভাসের প্রশ্নে মাথা নাড়ে বাচ্চাটি, "শিবু, আমি পাঁউ খাব।"

পাঁউরুটির বাকি অংশ বিভাস বাচ্চাটিকে দিয়ে দেন, এবং তার পর অনেক প্রশ্নোত্তর করে বোঝেন শিবুর বাড়ি অনেক দূরে, বাড়িতে ওর বাবা মা ছিলো, কিছুদিন আগে ওর মা মারা যায় তারপর থেকে বাবার কাছে থাকতো। দিন দুই আগে ওর বাবা ওকে সকালে নতুন জামা পরিয়ে ট্রেনে করে এখানে নিয়ে আসে তারপরে খাবার নিয়ে আসছি বলে ওকে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে আর ফেরেনি। শিবু এদিক ওদিক খুঁজেছিলো কিন্তু পায়নি। সেই থেকে শিবু এখানেই আছে।
বাচ্চাটার মিষ্টি মুখ আর গল্পটা বিভাসকে ভারি কষ্ট দিয়েছিলো কিন্তু ওদিকে ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছিল বেঞ্চ থেকে উঠে মূল প্ল্যাটফর্মে আসার পথে পিছু ফিরে চেয়েছিলেন, দেখেন শিবু হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে টাটা করছে, দেখে বিভাসের মুখটা মুচড়ে ওঠে, ফিরে গিয়ে শিবুকে কোলে নিয়ে আর এক হাতে ব্যাগ নিয়ে কোনমতে ট্রেনে উঠে পড়েছিলেন। আর একটু হলেই ট্রেনটা মিস হয়ে গেছিলো সেদিন।

সেদিন রাতে বিভাস বাবু যখন বাড়ি ফিরলেন তখন বেশ হাসি মুখ। স্বভাব গম্ভীর রাগি বিভাস বাড়ির নিচ থেকেই সারদার নাম ধরে ডাকছেন

"কই গো সারদা কোথায় গেলে? এই যে রোজ আমার কান ঝালাপালা করো, ‘ছেলেরা বড় হয়ে গেলো, আমার সময় কাটে না, কি নিয়ে থাকবো’, তা শুনতে শুনতে আজ একটা ব্যবস্থা করেই ফেললাম বুঝলে, হাজার হোক তোমার কথাটা তো ফেলতে পারি না।"

দোতলা থেকে সারদা ভাবছেন কর্তার হোল কি, কবে তিনি বলেছিলেন তার সময় কাটে না, বলে মরার সময় পান না তিনি, কবেই বা আফসোস করেছিলেন ছেলেরা বড় হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বুঝলেন একটু বাদে যখন কর্তা একটা বছর তিনেকের ঘুমিয়ে পড়া বাচ্চাকে তার কোলে তুলে দিলেন।

"দেখছো কি? এর নাম শিবু, ভালো নাম দেবো শিবপ্রসাদ, এই হোল তোমার ছোট ছেলে, ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু খাইয়ে দাও দিকি।" সেই থেকে শিবু রয়ে গেছে এই সংসারে। স্কুল কলেজেও পড়েছে তবে লেখাপড়ায় তার মাথা কম ছিলো। বর্তমানে তাকে একটি ছোট খাবারের দোকান করে দিয়েছেন। ছোটবেলার মত শিবু এখনও খুব খেতে ভালোবাসে, সেই দোকান এবং ছোটখাটো ক্যাটারিং সে বেশ ভালোই চালাচ্ছে।

শিবুও বাবাকে খুব ভয় পায়, গাড়িতে যেতে যেতে আড়চোখে বাবার গম্ভীর মুখ দেখে ওরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো, এই হতভাগা সুকান্ত ঘোষকে ও কোনদিনই পছন্দ করে না। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে শিবু বল মেরে ওর বাড়ির কাচ ভেঙে দিত আর উনি চিল্লিয়ে পাড়া মাৎ করতেন। এতদিন বাদে সেটারই প্রতিশোধ নিলেন কি না কে জানে!

যথানিয়মে এবং শাস্ত্রে শিবু আর মানসীর বিয়ে দিয়ে ফিরলেন বিভাস, বরণ করে তুললেন সারদা। বৌভাতের পরদিন সবাইকে ডেকে পাঠালেন বিভাস, একতলার বড় ঘরে।

"শিবুর বিয়ে দিয়ে আমার শেষ এবং মস্ত দায়িত্বটা পালন করতে পারলাম, আজ একটু নিশ্চিন্ত লাগছে। আমার আর সারদার বয়স হয়েছে, কাজ কর্ম কমিয়ে দেবো, দুই বুড়োবুড়ি তীর্থ করবো বেশি। তোমরা দেখবে কাজ এমনই ভেবেছিলাম।" থেমে গিয়ে দম নেন বিভাস। সবাই এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বাবা কি বলতে চান!

"কিন্তু শিবুর বিয়ের দিন সুকান্ত ঘোষের কথায় আমার বড্ড চিন্তা হয়েছে। শিবু তোমাদের সহোদর ভাই নয় কিন্তু আমি আর তোমাদের মা ওকে নিজের ছেলেই মনে করি, করবো। কিন্তু তোমরা কি তাই মনে করো? আমাদের অবর্তমানে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে যদি তোমাদের ঝগড়া হয় তাহলে! কেউ তো বলতেই পারে শিবু তো বিভাস দাসের নিজের ছেলে নয় তবে সে কেন ভাগ পাবে। এইসব চিন্তাভাবনায় মন বড় উচাটন। এই ব্যাপারে আমি তোমাদের সবার মত জানতে চাই। যা বলার পরিষ্কার করে বলো।"

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। বিভাসের সামনে চট করে কিছু বলবে এমন সাহসও নেই। অবশেষে রুপু কিছু বলতে উদ্যত হোলো। কিন্তু তার আগেই নতুন বৌ মানসীর গলা শোনা গেল।

"আমি কিছু বলতে পারি বাবা?"

অবাক বিভাস মুখ ফেরান, "হ্যাঁ ছোট বৌমা বলো।"

"বাবা আমি যখন দশ বছরের ছিলাম সুন্দরবনের গ্রামের মেয়ে তখন বনে মধু আনতে গিয়ে বাপ আর ঘরে ফেরেনি, বাঘের পেটে গেছিলো। ঘরে আমি ভাই আর মা। অভাবে খেতেই পেতাম না। বছর দু এক বাদে কার সাথে যেন ঘর ছেড়ে মা চলে যায়, যাবার সময়ে ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু আমাকে নয়। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি একা। এর ওর তার দোরে ঘুরেছি, লাথি ঝ্যাঁটা খেয়েছি। তারপরে ওখানকারের দিদিমণি সরলাদিদির নজরে পড়ি। সরলাদিদি আমাকে ইস্কুলে আবার ফেরত আনে। স্কুলের পরে বড়দিমণির বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতাম ওখানেই থাকতাম। এত কাজ করাতো পড়ার সময়ই পেতাম না।"

চোখ মোছে মানসী। "মাধ্যমিক পাশ করার পরে সরলাদিদি হোমে থাকার ব্যবস্থা করলেন। এখানে এসে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম, সেলাই শিখলাম। একুশের পরে হোম থেকে চলে যাবার কথা। সেলাই দিদিমণি হিসেবে বহাল হলাম। ছোটবেলা থেকে ঘর বলে কিছু পাইনি, পরের আশ্রয়ে বাস, ভয়ে ভয়ে থাকা। আমার কখনো বিয়ে হবে, সংসার হবে এমন বাড়ি এমন পরিবার এতো স্বপ্নেও দেখিনি কোনদিন।"

"বাবা আমি ওর থেকে সব শুনেছি। সেদিন আপনি যদি ওকে স্টেশন থেকে না আনতেন ও হয়তো ওখানেই বড় হোত, ভিক্ষে করতো বা পকেটমারি। নেশা ভাঙ শিখে চোর ডাকাতও হতে পারতো। আজ ও এই বাড়ির ছেলে। সবাই কত ভালোবাসে সেটা তো কাল থেকেই দেখছি। আমাদের জন্য যেন এই পরিবারে কোন বিবাদ না হয়। আমাদের কোন সম্পত্তি চাই না বাবা। ও তো দোকান চালাচ্ছে, আমিও সেলাইয়ের দোকান খুলবো যেমন দিদিভাই বলেছে মানসী বুটিক। আমরা খেটে খাবো, মাথার ওপরে আপনারা রইলেন আর কিচ্ছু চাই না।"

সারদা এগিয়ে গিয়ে মানসীকে জড়িয়ে, আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেন, নিজের চোখও মুছে নেন। শিবু হাঁ করে তার নতুন বৌএর কথা শুনছে আর ভাবছে বাবা দেখে শুনে জহুরীর মত ঠিক হিরে খুঁজে এনেছেন।

সবাই চুপ এমন সময়ে রুপু নিজের স্বভাবমতই হাঁউমাউ করে উঠলো।

"বাবা আপনি বড়দের কথার মধ্যে ছুটকিকে এত কথা বলতে বারণ করুন না। ওর পুরোনো জীবন নিয়ে যেন আর না ভাবে। আর কখনো ওকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। আর রইলো বাকি আপনার প্রশ্ন। আপনার তিন ছেলে আমি শমিতা আমাদের সবার তরফ থেকে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি আপনার সম্পত্তি আপনি ঠিক করুন কাকে কি দেবেন কতটা দেবেন, এই নিয়ে আমরা কিছুই বলবোনা কোনদিন। খালি একটাই কথা, আপনি রাগটা একটু কমান এবারে,অন্তত মায়ের কথা ভেবে।"

বিভাস চুপ করে যান কিছুক্ষণ তারপরে একগাল হাসেন,

"সারদা এদিকে এসে আমার পাশে বোসো । এই অভি, তিন মেয়ের সাথে আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দে তো।" বাবার এহেন বার্তায় সবার মধ্যে হাসির ঢেউ খেলে যায়। প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরে গিন্নির পাশে কোলে নাতনিকে আর সামনে তিন মেয়েকে নিয়ে বসে বিভাস আর সারদার মুখে সলজ্জ রক্তিমা ছড়িয়ে পড়ে।

সমাপ্ত

© FB.com/rituparna.rudra.9



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~