Bessa Ma - A bengali story

Jolchobi

বেশ্যা মা

অন্তরা রায়

পুলিশের জিপটা ওদের উঠোনের ওপরে এসে দাঁড়ালো | রসালো খবরটা পাঁচকান হতে খুব বেশি সময় লাগেনি | আশেপাশের উৎসুক চোখগুলো বেশ্যা পল্লীর এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলছিলো একে অন্যের অলক্ষ্যে | নষ্টামোর শব্দবানের ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওদের লক্ষ্য করে চারদিকে | তথাকথিত দিনের সূর্য্যের মতো ঝকঝকে চরিত্রবান লোকজন ওদের গায়ের পাঁক নিয়ে রসের আলোচনা জমিয়ে ফেলেছে এই মাঝ রাতে | মনীশ মালহোত্রাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নার্সিংহোমের গাড়িতেই | লোকটা মনে হয়না বাঁচবে |তখনও ঘরের অন্যপ্রান্তে একা দাঁড়িয়ে আছে বেশ্যা পার্বতী | বুকের কাছে ঘুমন্ত মেয়েটা | মেঝে জুড়ে রক্তের স্রোত প্রায় শুকিয়ে এসেছে |

ঘন্টাখানেক আগেও কিন্তু ঘরটা এমন ছিলনা |পার্বতীর খোঁপা জুড়ে ছিল বেলফুলের মালা | লালের ওপর রোলেক্সের কাজ করা শাড়ীটা কিছুতেই ঢাকতে পারছিলো না ওর নিশি ডাকের মতো আধখোলা শরীরটাকে | ভুরভুর করছিলো উগ্র আতরের ইশারা | ঘরে নীল সিন্থেটিক কাগজ ছিঁড়ে বেড়িয়ে এসেছিলো লিলি ধূপের শোকের গন্ধ | প্রতিটা সন্ধ্যে ওদের নিত্যনতুন মৃত্যু শরীরে মাখিয়ে দেয় পরম যত্নে |

ঊর্মি নিজের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে এঘরওঘর জুড়ে | ওর মা নেই | কোনো এক শীতের রাতে বস্তা জড়িয়ে মৃত্যুর কোলে পাপটাকে কেউ রেখে গেছিলো | অবৈধ অথবা কন্যাসন্তান হওয়ার অপরাধেই হয়তো মায়ের কোলের পরিবর্তে কুকুরের দাঁতের ফাঁকে ঠাঁই জুটেছিল সদ্যোজাতটার | কুকুরটার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো কিছুআগে মায়ের সাথে থেকে যাওয়া শেষ চিহ্নটা | কুকুরের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পার্বতী | কারুর মেরে ফেলতে চাওয়া বাড়তিটা পার্বতীর বুকে ঠাঁই পেলো | সবার বারণ উপেক্ষা করে ঊর্মি আজ পার্বতীর একমাত্র অবলম্বন |

পার্বতীর আগেও একটা অবলম্বন ছিল , সে রামু | মন্ডলপাড়ার এক দর্জির স্যানাত | টুকটাক কিছু করতো | হেব্বি নাকি লাগতো পার্বতীকে | দু চোখ জুড়ে স্বপ্ন এঁকেছিল পার্বতীর | সেদিন যখন রামুর সাথে বেরিয়ে পড়েছিল স্বপ্নের মতো ভবিষ্যতের খোঁজে | কি সুন্দর না লাগছিলো পার্বতীকে | না না , সেদিন ও পার্বতী ছিল না | ওর নাম ছিল টিয়া | টিয়া সরখেল | বাপটা সৎমায়ের চাপে কিছু বলতেই পারতো না | ধুর , পরে পরে মার খাওয়া শুধু | তারচেয়ে বরং একটা নতুন সংসার হোক | পার্বতী হলুদ নীল ছাপা শাড়ী , লাল ব্লাউস , লালফিতে দিয়ে সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়েছিল | রামু শাঁখা,সিঁদুরও কিনেছিলো | ওকে নিয়ে শুধু মন্দিরের জায়গায় এসেছিলো বেশ্যা পল্লীতে | ওই শেষ তারপরে আর কখনো দেখেনি লোকটাকে | মালটা ক'হাজার টাকায় পার্বতীর ভালোবাসাকে বেচে দিয়েছিলো | আজ আর সেসব কথা ও মনে করতে চায়না | বুকের ভেতরে যে হাতুড়ির ঘা পরে একটার পর একটা | চোখটায় যেন অজস্র কাঁচের গুঁড়ো কিড়মিড় করে |

বড়বাজারের লোহা ব্যবসায়ী গণেশ মালহোত্রার বড়ো ছেলে মনীশ পার্বতীর পার্মানেন্ট খদ্দের | লোকটার বৌ মারা গেছে মাস সাতেক আগে | তারপর থেকেই পার্বতী | বিদেশী মদ ছাড়া লোকটার মুখে রোচে না | ছিঁড়ে খায় পার্বতীকে প্রতি রাতে | অসুরের মতো শক্তি লোকটার গায়ে | পুরো পয়সা উসুল করে তবেই ছাড়ে ওকে | রাগ হলেও পার্বতী মিহি গলায় বলে ...

-- ও বাবু ছিঁড়ে ফেলবে বুঝি আমাকে ? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি ?

বুনোশুয়োরের মতো ভোঁসভোঁস করতে থাকে লোকটা |

-- দুঃশালী , বড়া নাখড়িওয়ালী হ্যায় তু | দিমাগ মাত চাট ইয়ার | লেটে রাহে চুপ সে |

সারাশরীরে কালশিটে আর দাঁত নখের দাগ | মুখ জুড়ে লাল কালো লিপস্টিক আর কাজল মেখে যায় | ঠিক জোকারের মতো লাগে ওকে | ঘরের চারিদিকে ফুলের মালা , ব্লাউস , শাড়ী , অন্তর্বাস ছড়িয়ে থাকে | শরীরখেকো হিংস্র পশু একটা | হাঁপিয়ে ওঠে পার্বতী তবু কিছু প্রকাশ হতে দেয়না | সামলে নেয় নিজেকে | লোকটা মুখের ওপর ছুঁড়ে দেয় পাঁচশো টাকার বেশ কয়েকটা নোট্ |

সেদিনও লোকটা এসেছিলো অন্য দিনের মতোই | ঘরে ঢুকেই পার্বতীকে বললো ...

-- মোড় কি উস দুকান সে যারা চিকেন কাবাব লে আনা | বহত খুসবু আ রাহি হ্যায় | আজ কুচ অর সে কাম নেহি চলেগা |

পার্বতী ব্লাউজের হুকগুলো আটকে হাসতে হাসতে দোকানের উদ্দ্যেশে রওনা দিলো | বলে গেলো ..

-- বাবু , তুমি ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও | যা সব ছিঁচকে মাতালগুলোর উৎপাত | যকনতকন যার তার ঘরে ঢুকে পোচ্চে গো | দাও দিকি বন্ধ করে | ও দোকানে গেলে এক ঘন্টা , যা লম্বা লাইন ..!

কুড়ি মিনিটের মধ্যে ও ফিরে আসে | খুব বেশি ভিড় ছিলোনা |

ঘরের দরজা খোলা , বাবু নেই | চলে গেলো নাকি ? নাঃ ...| শার্ট , পার্স , আধ খাওয়া মদের বোতল সবই তো রয়েছে | এদিকওদিক তাকাতেই পাশের ঘর থেকে টেবিলল্যাম্পটার ভাঙার আওয়াজ পায় | ঊর্মি গোঙাচ্ছে | জানলা থেকে নিবুনিবু আলোয় ঘরের ভেতরটা অস্পষ্ট | খাটের ওপর চিৎ করে শুইয়ে ফেলেছে পাঁচ বছরের মেয়েটাকে | এক হাতে চেপে ধরেছে ওর মুখটা অন্য হাতে ছিঁড়ে খুলছে ওর ফ্রকটা | চিৎকার করে ওঠে পার্বতী | এক লাথিতে খুলে ফেলে দরজাটা | বাচ্চাটা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদছে | হিড়হিড় করে টেনে মাটিতে ফেলে শয়তানটাকে | লোকটার বুকের ওপর পার্বতীর একটা পা | ভয় পেয়ে গেছে জানোয়ারটা | গায়ে ঢলে পরা মেয়েটার এই রূপ হতে পারে তা শয়তানটা ভাবতেও পারেনি | পার্বতীর হাতে পায়ে ধরছিল লোকটা |

-- হারামির বাচ্চা , আমার মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস তোকে কে দিয়েছে | চিরদিনের মতো তোর শখ আমি শেষ করে দেবো |

হাতের কাছে গোলটেবিলের ওপর ছিলো ধারালো জাতিটা |পার্বতী জানে ধর্ষকের ঠিক শাস্তিটা কি |
আর্তনাদে কেঁপে উঠেছে সমস্ত বেশ্যাপল্লী | পার্বতীর গায়ে ছিটকে এসেছে অসুরের রক্ত |

ততক্ষনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নাজনীন , শিউলি , নয়না , মাতন |বাবুরা যে যার মতো পলায়ন ততক্ষনে | ওরাই ফোন করেছে হাসপাতাল , থানায় | থানার বড়বাবুকে দেখে এগিয়ে আসে নাজনীন |

-- বাবু , বেঁচে থাকার জন্য শরীর বেচি | তা বলে আমাদের মেয়েগুলোর ইজ্জত নিয়ে খেলা ? অত আইনকানুন জানিনা বাবু | কোনো শুয়োরের বাচ্চা ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছুঁতে এলে পুঁতে রেখে দেবো |
এগিয়ে আসে শিউলি | ফুলের মতো মেয়েটা বাবু | মেরে ফেলছিলো লোকটা ইচ্ছে করে | যদি ওর মা ঠিক সময়ে না আসতো ? কি হতো মেয়েটার ? যদি আপনার ঘরের মেয়েটার সাথে ঠিক এমনটাই হতো বাবু ? চুপ করে থাকতে পারতেন ?

থানার বড়োবাবু ওদের আশ্বস্ত করেন উনি নিজে পুরো ব্যাপারটা দেখবেন কথা দিয়েছেন | পার্বতীকে জিপে তোলে পুলিশ | ঊর্মিকে আজ ঘিরে রেখেছে ওর মায়েরা | হ্যাঁ , বেশ্যা মায়েরা | কারণ ওরা একটা পক্ষই জানে ..... মাতৃপক্ষ ||

সমাপ্ত

© FB.com/profile.php?id=100008760457115



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~