Boumoni - A bengali story

Jolchobi

বৌমনি

তানিয়া দত্ত

বৌমনি যখন বিয়ে হয়ে এলো তখন আমার ক্লাস টেন। আমার নিজের কোনো ভাই বোন নেই। পাশের বাড়ির টুবাই দাদার বউ হলো আমার একমাত্র বৌমনি, আমার সুখ দুঃখের সঙ্গী।

প্রথম প্রেম, প্রথম টিউশন কেটে ঘুরতে যাওয়া, প্রথম ডেটিং সব কিছু জানার একমাত্র অধিকারিনী আমার বৌমনি। ছোটো থেকেই আমি খুব ডানপিটে। মা বলতো, “ ঠাকুর তোকে ছেলে করতে গিয়ে মেয়ে করে দিয়েছে ”। বকাও খেতাম প্রচুর। আর মায়ের বকুনির হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে সদা সর্বদা হাজির বৌমনি । আমার সব আবদার হাসি মুখে মেটাতো। শপিং যাবো বৌমনি কে চাই, ফুচকা খাবো তাতেও আমার একমাত্র সঙ্গী সেই বৌমনিই। আমার থেকে মাত্র তিন বছরের বড়ো বলে হয়তো আমাদের বন্ধুত্ব টা এতো গাঢ় হয়েছিলো। বৌমনি আমাকে নিজের বোন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতো না।

টুবাই দাদার বাবা মানে রবীন কাকু ও খুব ভালো মানুষ। কাকীমা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। আমার তাকে তেমন মনেও নেই। তাই সংসারের হাল ফেরাতে তাড়াহুড়ো করে টুবাই দাদার বিয়ে টা দিয়েছিলো কাকু। তখন বৌমনি সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। বৌমনি আসার পরে বাড়িটায় শ্রী ফিরলো। ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। আমিও উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম। স্কুল নেই পড়া নেই সারাক্ষন লাট্টুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি আর ছেলে দেখছি। আর তার বিস্তারিত বিবরন আমার একমাত্র শ্রোতা বৌমনিকে শোনাচ্ছি। এমনই একদিন টইটই করে ঘুরে এসে বৌমনি কে গেছি গল্প শোনাতে।

- “জানো তো বৌমনি আজ কী হয়েছে?”

- “কী হয়েছে রে?”

- “একটা ছেলে কে দেখলাম সাউথ সিটি মল্ এ। উফ্ কী দেখতে!!”

- “ও আচ্ছা”

- “তুমি দেখলে না পাগল হয়ে যাবে”।

- “তা পাগল ই যখন হয়ে যাবো তখন আর দেখে কাজ নেই”।

- “ধুর বাবা! তোমার কী হয়েছে বলতো? আমার কথায় কোনো মন নেই, কী হয়েছে?”

- “কী হবে আবার ! আমার শরীর টা ভালো নেই রে মিষ্টি। তাই আর কি”।

- “ওমা সেকি! কী হয়েছে দেখি, জ্বর নাকি?” বলেই কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিলাম। হাত ঠান্ডাই ছিল। কিন্তু বৌমনি আহ্ করে কঁকিয়ে উঠলো, যেন ব্যাথা পেয়েছে।

- “কী হয়েছে দেখি হাতে?”

- “আরে কিছু না তুই বল না কী যেন বলছিলি? কী নাম ছেলেটার?”

বুঝলাম বৌমনি আমার কথা কিছুই শোনেনি। জোর করে হাত টা টেনে নিয়ে দেখলাম হাতে কালশিটে পড়ে গেছে।

- “কী করে এমন হল বৌমনি?”

- “ওই পড়ে গিয়েছিলাম, আর বলিস না নিজের অজান্তে কখন তেল ফেলেছি রান্নাঘরের মেঝে তে। আর তাতেই পা পিছলে পড়ে গেছি”।

- “ও আচ্ছা তাই বলো। দাও আমি মলম লাগিয়ে দিই”।

বৌমনির হাতে মলম লাগিয়ে বাড়ি আসতেই মা রে রে করে তেড়ে এলো।

- “বলি রোজ রোজ ও বাড়ি যাওয়ার কী আছে শুনি? সারাক্ষন শুধু বৌমনি আর বৌমনি। তোর তো মা বাবা ও আছে নাকি? কী নিয়ে পড়বি এসব না ভেবে শুধু ও বাড়ির বউ এর চামচাগিরি করা। মেরে পা খোঁড়া করে দেব বলে দিলাম”।

কখনো মা এভাবে বলেনি বৌমনির সম্পর্কে। মা ও বৌমনি কে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আজ কেন এভাবে বললো বুঝলাম না। অন্য সময় বাবা এসে আমার পক্ষ অবলম্বন করে মা কে শান্ত করে। কিন্তু আজ বাবাও চুপ। কেমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মা সিঙাড়া ভাজছে। দেখেই তো জিভে জল চলে এলো। মাকে গিয়ে বললাম,

- “মা দুটো সিঙাড়া দাও তো বৌমনি কে দিয়ে আসি”।

-“ কাউকে দিতে হবে না। নিজে খেলে খা। নাহলে দূর হ। আমার অনেক কাজ আছে”।

- “তোমার কী হয়েছে বলতো? বৌমনির নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছো, কী হয়েছে?”

- “একটা অসভ্য মেয়ের হয়ে সালিশি করিস না তো। কী করেছে তোর বৌমনি জানিস? একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাও আবার হাত ধরে। মিলির মা দেখেছে। সারা পাড়ার লোক জানে। রবীন দা তো তোর বাবার কাছে খুব দুঃখ করছিলেন। এতো ভালো মানুষ উনি। বউ টা মান সম্মান কিছু রাখলো না”।

আমার মুখটা এতো বড়ো হা হয়ে গেল যে একটা গোটা সিঙাড়া একবারেই ঢুকে যাবে। বৌমনি এটা করেছে? যে শুধু আমার মুখে ছেলেদের গল্প শোনে। কাউকে দেখতে অব্দি চায়না। আদ্দিকালের বদ্যিবুড়ির মতো বোতাম টেপা ফোন ব্যবহার করে। সোশ্যাল মিডিয়া তো দূর অস্ত। সে কিনা অন্য ছেলের সাথে!! না না বন্ধু টন্ধু হবে হয়তো। কিন্তু এত কিছু হয়ে গেল বৌমনি আমাকে একবারও জানালো না!!

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

- “ও বৌমনি, বৌমনি দরজা খোলো”।

- “আয়”।

- “তোমার সাথে জরুরি কথা আছে”।

- “আগে বস। তোর পছন্দের ফ্রায়েড রাইস্ আর চিলি চিকেন করেছি। খেয়ে বল কেমন হয়েছে”।

- “ওসব পরে। আগে বলো ছেলে টা কে?”

- “কোন ছেলে?”

- “যার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে। কে সে? আমাকে তো একবারও জানালেনা। আমি তো তোমায় সব বলি বলো”।

- “ওটা আমার একটা বন্ধু হয়”।

- “এটা কেমন বন্ধু যার সাথে প্রায়ই দেখা করতে হয়? আর সব থেকে বড়ো কথা তুমি আমায় একবারও বললে না?”

- “এটা জানানোর কিছু নেই মিষ্টি। আমি আমার বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছিলাম এতে বলার কী আছে?”

- “বুঝেছি। সবাই যেটা বলছে সেটাই সত্যি। শুধু বন্ধু হলে আমায় বলতে তুমি। এভাবে টুবাই দাদা কে ঠকালে তুমি? আমি বিশ্বাস করিনি যে আমার বৌমনি এমন। এখন বুঝলাম আমি ভুল। ছিঃ!!”

বলে বেড়িয়ে এলাম ওই বাড়ি থেকে। তারপর থেকে আর যাইনি বৌমনির কাছে। অভিমানে। কষ্ট হচ্ছিলো যে বৌমনিকে আমি এতটা ভুল চিনলাম? কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে বৌমনি খারাপ। সারা পাড়া রটে গেল বৌমনি দুশ্চরিত্রা।

হঠাৎ একদিন রবীন কাকু বাবার কাছে এসে কেঁদে ফেললো। মা ও গেল। বৌমনি নাকি কাল রাতে পালিয়ে যাচ্ছিলো তার প্রেমিকের সাথে। বৌমনিকে স্টেশন থেকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। আর ছেলেটা পালিয়ে গেছে। বাবা বললো, -“ কী আর করবে। ডিভোর্স করিয়ে নাও। এভাবে তোমাদের সাথে সাথে পাড়ার সম্মানও নষ্ট হচ্ছে”।

- “কী করবো বলো প্রদীপ, মেয়েটার উপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে। বেয়াই মারা গেছেন। বেয়ান ছেলের সংসারে থাকেন। ওদের জানাতেও খারাপ লাগে। আর টুবাই ওকে এতো ভালোবাসে তাই ক্ষমা ঘেন্না করে দিয়েছি”।

মন খারাপ করে নিজের ঘরে এলাম। বৌমনির প্রতি ঘেন্না জন্মালো আমারও। ডিনার টেবিলে মা বললো,

- “কী হল কিছুই তো খাচ্ছিসনা”।

- “ভালো লাগছে না”।

বলে উঠে গেলাম। মা আবার শুরু করলো লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া।

-“ এই মেয়ে উচ্ছন্নে গেছে ওই বাড়ির বউ এর সাথে মিশে মিশে। আজ শুনলাম ফোনে কোন ছেলের সাথে কথা বলছে। আমার মেয়ে টাকে নষ্ট করে দিলো ওই চরিত্রহীন বউটা। এই শোন তোর ফোন আজ থেকে আমার কাছে থাকবে”।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সবথেকে কাছের বন্ধু বৌমনি গেছে এবার ফোন টাও গেল।

মনের দুঃখে মিলির সাথে বিকালে গেলাম ফুচকা খেতে। এক কাকিমা বললো,

- “কীরে মিষ্টি এখন তোর বৌমনির সাথে মিশিস না বুঝি?”

বুঝলাম আমাকে ঠেস দিয়ে বললো কথাটা।

- “না মেশাই ভালো বুঝলি। এতো ভালো শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে যে মেয়ে বারমুখো হয় সেই মেয়ের সাথে মিশলে তুইও অমন হয়ে যাবি”।

খারাপ লাগলেও বৌমনির প্রতি ততদিনে আমার ধারণাও এমনই তৈরী হয়েছে। তবু বৌমনির নামে কেউ কিছু বললে আমার খুব কষ্ট হয়।

তারপর কিছুদিন সব চুপচাপ। ব্যাপার টা অনেকটা থিতিয়ে এসেছে। আমিও বৌমনির থেকে সরে এসেছি অনেকটা। কলেজে ভর্তি হয়েছি জিয়োগ্রাফি অনার্স নিয়ে। শীতকাল। ফার্স্ট ইয়ারের শুরু। চাপ কম। তাই আমি আর মিলি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। হঠাৎ রবীন কাকু আমায় ডাকলেন। যদিও ওই বাড়িতে যাওয়া আমার বারণ। যেতে ইচ্ছেও করে না। ইতঃস্তত করছিলাম। কিন্তু কাকু ডাকায় না গিয়ে পারলাম না।

গেলাম ওই বাড়ি। কাকু আমায় সোফায় বসতে বলে নিজের ফোন টা নিয়ে এলো। বললো,

- “দেখ তো মিষ্টি আমায় একটু শিখিয়ে দিতে পারিস কিনা ওই ফেসবুক টা”।

- “কাকু তুমি ফেসবুক করবে নাকি?”

- “হ্যাঁ রে। আমার সব বন্ধু রা ওই ফেসবুকে আছে। তাই আমিও একটু। হে হে”।

- “আচ্ছা বসো শিখিয়ে দিচ্ছি”।

কাকু আমার পাশে বেশ গা ঘেঁষে বসলেন। হাত ঘষতে ঘষতে বললেন,

- “দেখ মিষ্টি আমার হাত টা কী ঠান্ডা”।

বলে কাকু হাতটা আমার মাথার পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে আমার কাঁধে রাখলো। আমি কেঁপে উঠলাম। সত্যি হাতটা খুব ঠান্ডা। আমি হেসে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে শেখাতে লাগলাম। কাকু প্রায় আমার গায়ের উপর উঠে হাঁ করে দেখতে লাগলো। আর খুব আগ্রহ সহকারে সব শিখতে লাগলো। বুঝলাম কাকু বেশ মজা পেয়েছে ফেসবুকের এত বৈচিত্র্য দেখে। আমি খুশি মনেই শেখাতে লাগলাম। হঠাৎ কাকু আমার বাম পায়ের উপর একটা চাপড় মারলেন। বললেন,

- “কী মশা হয়েছে দেখেছিস, জানলা বন্ধ করতে দেরি হয়েছে আর ব্যাটারা সানন্দে এসে ঘরে ঢুকেছে”।

তখনই বৌমনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসে ঢুকলো। কাকু বৌমনি কে দেখে অসন্তুষ্ট হলেন। আমি অনেকদিন পরে বৌমনিকে দেখলাম। খুব রোগা হয়ে গেছে বৌমনি। চোখের তলায় কেউ যেন একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে। দেখে খারাপ লাগলেও কিছু বুঝতে দিলাম না। আমিও কাকুর মতোই গম্ভীর হয়ে রইলাম।

- “বাবা আপনি মিষ্টি কে ডেকেছেন কেন?”

- “ওর থেকে ফেসবুক শিখছি। কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো”।

- “আপনি ওকে যেতে দিন। সন্ধ্যে হয়ে এলো। কাকু কাকিমা চিন্তা করবে। আমিতো আছি”।

কাকু দেখি ভালমানুষ এর মতো বৌমনির কথা মেনে নিলেন। আমি বাড়ি এসে মা কে সব বললাম।

- “জানো মা বৌমনি খুব রোগা হয়ে গেছে। কত সুন্দরী বৌমনি। আর এখন কেমন হয়ে গেছে”।

- “মনে পাপ থাকলে এমনই হয় বুঝলি। মুখ ই হলো মনের আয়না। মনটা তো কুৎসিত তাই মুখের এমন দশা”।

খুব ইচ্ছে করে বৌমনির কাছে যেতে কথা বলতে কিন্তু কেমন যেন একটা বাধা। আজ মিলির সাথে কলেজ থেকে ফিরছিলাম। পাড়ায় ঢুকবো দেখি একটা ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে। আড়চোখে ছেলেটাকে লক্ষ্য করতে করতে এগোচ্ছি। দেখি ছেলেটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। বেশ হ্যান্ডসাম তো ছেলেটা। বেশ ভালো লাগছিলো। তিনটে প্রেম যদিও ব্রেক আপ হয়ে গেছে। এখন আমি সিঙ্গেল। তাই ছেলেটাকে দেখে প্রেম প্রেম পাচ্ছিল। তিন দিন পরপর ছেলেটাকে দেখলাম। আজ চতুর্থ দিন। আমি একাই ফিরছিলাম। আজও সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি এবার সোজাসুজি ছেলেটার দিকে তাকালাম। ও মুখ নিচু করে নিলো। আমি এগোতে যাবো তখনই,

- “এই যে শুনছো?”

- “হ্যাঁ বলুন”

আমার বুকের মধ্যে তখন ধুম তানা নানা নানা ধুম তানা নানা নানা চলছে। তবুও যতটা সম্ভব স্মার্টনেস বজায় রেখে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

- “বলছি তুমি কি মিষ্টি?”

আরিব্বাস এ ছেলে দেখছি আমার নাম টাও জেনে নিয়েছে। ফিফটি পার্সেন্ট তো প্রেমে পড়েই গেছিলাম। এবার হান্ড্রেড পার্সেন্ট পড়ে গেলাম। যদিও আমার ক‍্যারেক্টর খুবই স্ট্রং। এত সহজে আমি প্রেমে পড়িনা।

- “হ্যাঁ আমি মিষ্টি”

মনে মনে ‘ তুমি চাইলে শুধু তোমার মিষ্টি ও হতে পারি’।

- “আমার নাম প্লাবন ।আমাকে তুমি চিনবেনা। আমি একটা বড় ফার্মাসিউটিক্যালস এ কাজ করি”।

প্লাবন!! আমার মনেও এখন প্রেমের প্লাবন চলছে। মনের দুই কুল প্লাবিত হচ্ছে। ও আরো যেন কিসব বললো। কিছুই আমার কান এ গেল না।

- “মিষ্টি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে”।

ঠিক তখনই মিলি কাবাব মে হাড্ডি হয়ে নাচতে নাচতে এসে বললো,

- “কি রে কার সাথে কথা বলছিস?”

ছেলেটা সাথে সাথে হেলমেট পড়ে বাইক নিয়ে হুঁশশ।

মনে মনে মিলিকে যে কতগুলো গালি দিলাম নিজেও গুনে দেখলাম না। যদিও আমি এসব গালি গালাজ একদম ই জানিনা।

সেই থেকে আমার হৃদয় ক্ষনে ক্ষণে প্লাবিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমিও মেঘেদের মতো হাওয়ায় ভাসছি।

আজ আবার প্লাবন দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। বেশ কিছুদিন ও আসেনি। আজ ওকে দেখে নিজেই এগিয়ে গেলাম। বললাম

- “আপনি এতদিন আসেননি কেন? কী যেন বলবেন বলছিলেন সেদিন?”

-“ এখানে কথা বলা টা নিরাপদ নয়। এটা আমার ফোন নম্বর। তুমি সময় করে আমাকে ফোন করো। যা বলার আমি ফোনে বলবো”।

বলেই আবার বাইক নিয়ে হাওয়া। আমিতো মহা খুশি। কিন্তু আমার ফোন যে মায়ের কাছে। বাড়ি গিয়ে অনেক বোঝালাম কিন্তু মা ফোন দিলোনা। বিকালে পড়তে গেছিলাম। ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেছিল। প্রায় দশটা বাজে। পাড়ার মোড়ে রকে বসে কতগুলো ছেলে তাস খেলে। ওখানকার একটা ছেলে বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে ফলো করছিল। আজ ও দেখি ওই ছেলেটা আমার পিছু নিয়েছে। তার মধ্যে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কারেন্ট টা চলে গেল। অন্ধকারে ছেলেটা এসে হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরলো। তখনও বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছাইনি। জায়গা টা ফাঁকা। আমি হাত পা ছুড়ছি কিন্তু ছাড়াতে পারছিনা। মুখ দিয়ে শব্দ ও করতে পারছিনা। ছেলেটার গা দিয়ে ভরভর করে মদের গন্ধ আসছে। ঘেন্নায় আমার হাত পা পেটের ভিতর সেধিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কে এসে ছেলেটাকে পিছন দিয়ে মারলো। ছেলেটা আমার হাত ছেড়ে দিলো। আমি পিছন ফিরে দেখি বৌমনি। আমার বৌমনি। আমি গিয়ে বৌমনি কে জড়িয়ে ধরলাম। বৌমনি বললো,

- “তোর এত বড় সাহস হলো কীকরে? দেখবি এখুনি পাড়ার লোক ডেকে জড়ো করবো”।

- “কেন সুন্দরী তোমার কীর্তি তো সবার জানা। তুমি তাহলে আমাকে খুশি করে দাও। আমি আর কারোর কাছে যাবোনা তাহলে মায়ের দিব্বি বলছি”।

বৌমনি হাতের বড়ো টর্চ টা নিয়ে তেড়ে যেতেই ছেলেটা দৌড়ে অন্ধকারে মিশে গেল। বৌমনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ আমি থাকতে তোর কিছু হবেনা। আমি তোর কাকুর জন্য টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ক্লাব থেকে ফিরতে পারবেনা এত অন্ধকার তাই। ভাগ্যিস এলাম”।

আমার মুখে ভাষা নেই। এই বৌমনি কেই না আমি কত খারাপ ভেবেছি।

হতে পারে বৌমনির চরিত্র খারাপ। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালোবাসা ষোলো আনা খাঁটি। ওই ছেলেটার নামে বৌমনি পুলিশ এর কাছে রিপোর্ট করলো। পুলিশ আর পার্টির ছেলেরা এসে ছেলেটাকে থ্রেট দিলো। তাসের ঠেক ও উঠে গেল। পাড়ার মেয়েদের আর কোনো ভয় রইলনা। কিন্তু বৌমনির বদনাম ঘুচলোনা। তবে আমার একটা উপকার হলো । পরেরদিন মা আমার ফোন টা দিয়ে দিলো।

রবীন কাকু খুব কালিভক্ত। কথায় কথায় বলেন ‘ সব ই মায়ের ইচ্ছে’। কাকুদের বাড়িতে শ্যামা সংগীত চলে রোজ নিয়ম করে। পাড়ার জেঠিমা কাকিমা রা কাকুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রণাম ঠুকে তবে যান। আর আমার মা ওই ঠাকুরের গান শুনতে শুনতে পুজো করতে বসেন রোজ। আজ ও তেমনই পুজো করতে বসেছেন।

-“ বুঝলি মিষ্টি রবীন দার বাড়ির শ্যামা সংগীত না শুনলে আমার পুজো করে তৃপ্তি হয়না। এই যাহ তোর বাবা তুলসী পাতা আনেনি এবার আমি নারায়ণ এর চরণে কী দেবো! যা না মা রবীন দা দের বাগান থেকে কটা তুলসী পাতা নিয়ে আয়”।

আমাদের বাড়িতে তুলসী গাছ নেই। বৌমনি ওদের বাড়ির পিছনের একফালি জায়গায় সুন্দর বাগান করেছে। তুলসী গাছ ও আছে। মা কে ব্যঙ্গ করে বললাম,

- “ওই গাছ কিন্তু বৌমনির লাগানো। ওই চরিত্রহীন বউ এর হাতে লাগানো গাছের পাতা তোমার ঠাকুর নেবেন তো?”

- “বেশী পাকা পাকা কথা বলিসনা মিষ্টি। ওই পাতা আমি গঙ্গা জলে ধুয়ে শুদ্ধ করে নেব”।

আমি মুখ বেকিয়ে গেলাম তুলসী পাতা আনতে। গিয়ে দেখি বৌমনিদের গেটে ভিতর থেকে তালা দেওয়া। আমি আর ডাকলাম না। আমাদের বাড়ি আর রবীন কাকুর বাড়ির মধ্যে মাত্র একটা চার ফুটের পাচিলের পার্টিশন। আর ওই পাঁচিল টপকানো আমার বাম হাতের খেল। পাঁচিল টপকে গেলাম তুলসী পাতা আনতে। রবীন কাকুর ঘরে গান চলছে,

“আমি যা করি মা সবই তোমার কাজ, আমার বলতে লাগে লাজ..”

দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বৌমনির ঘরের জানলার ধারের গাছ থেকে তুলসী পাতা নিতে গিয়ে যা দেখলাম, তুলসী পাতা নেওয়া আমার মাথায় উঠে গেল। জানলার একটা পাল্লা একটু খোলা ছিল। তাই দিয়ে দেখলাম, রবীন কাকু জানলার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছে। আর মেঝে তে ওটা কে? ওটা তো বৌমনি। গায়ে শাড়ি নেই। অর্ধনগ্ন অবস্থায় কাকুর পায়ে ধরছে আর বলছে

-“ আজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমার খুব শরীর খারাপ। দয়া করুন। আপনি আমার বাবার মত। একটু শুনুন আমার কথা”।

- “একদম চুপ। আমি তোর বাবার মতো। বাবা তো নই। কাল ও অনেক নখরা করেছিস। নেহাত কাল আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই বেঁচে গেছিস। ভালো কথায় বলছি আমাকে কোঅপারেট কর। নাহলে জোর করবো। তোর চিৎকার কারোর কানে পৌঁছাবেনা”।

আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা মাথা ঘুরছে। তুলসীপাতার কথা আর মনে নেই। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পাঁচিল টপকাতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে গেলাম। হাত পা কেটে গেল। হাত দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে আমার কোনো হুঁশ নেই। টলতে টলতে বাড়ি এলাম। ঠাকুর ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে ধপ করে বসে পড়লাম।

- “কীরে তুলসী পাতা আনতে এতক্ষন লাগে? দে দে তাড়াতাড়ি দে”।

মায়ের কথা শুনতেই পেলামনা। লক্ষ্মী নারায়ণের মূর্তির দিকে তাকিয়ে আমিও মূর্তির মতো বসে রইলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

- “একী করেছিস? হাত কাটলো কীকরে?”

মা পুজো, তুলসী পাতা সব ভুলে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ঘরে শুয়ে আছি। হাতে পায়ে মা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। এক মুহূর্তেই আমার গোটা পৃথিবী টা পাল্টে গেল। বুঝতে পারলাম এতদিন ধরে শুধু আমি নই আমরা সবাই মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলাম। কতদিন ধরে এসব চলছে কী জানি। আমাদের পাশের বাড়িতে এই কীর্তি চলছে আর আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পেলামনা!! রোজ কতটা কষ্ট সহ্য করে বৌমনি আর আমরা সবাই বৌমনি কে খারাপ ভেবে কত অকথা কুকথাই না শুনিয়েছি। আমিও কীকরে এতটা কষ্ট দিতে পারলাম বৌমনিকে? কীকরে এত অবিশ্বাস করলাম? নাঃ বৌমনিকে ওই নরক থেকে আমি বের করে আনবই। প্ল্যান করতে লাগলাম বৌমনি কে বাঁচানোর।

ধাক্কা টা কাটতে গোটা দিন টা লাগলো। কাউকে কিছু বললাম না। শুধু আমার মা আর মামা কে জানালাম। কারণ মামা ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারবেনা।

পরদিন..

- “কাকু আমি একটু শপিং এ যাবো। বৌমনি কে নিয়ে যাই?”

-“ নানা ওর অনেক কাজ। তুই তোর বন্ধুদের সাথে যা মিষ্টি”।

- “বন্ধুদের কারোর সময় নেই কাকু। প্লিজ। একটু নিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি চলে আসব”।

কাকু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা। অনেক কষ্ট করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হাতে হাত বুলিয়ে কাকু কে রাজি করালাম।

বৌমনি বললো, “ তুই রেডি হয়ে নে। আমি আসছি এখুনি”। কিছুক্ষন পরে বৌমনি আসতেই বৌমনি কে নিয়ে সোজা সাউথ সিটির কফি শপ।

- “কীরে তুই নাকি শপিং করবি? তাহলে কফি শপে এলি কেন?”
- “আমি শপিং করতে আসিনি”

- “মানে?”

- “তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো সব সত্যি সত্যি উত্তর দেবে”।

বৌমনির মুখটা কালো হয়ে গেলো।

- “কাকু তোমার উপর শারীরিক অত্যাচার করে কবে থেকে?”

- “এসব কী বলছিস তুই? নানা উনি কোনো অত্যাচার করেন না তো”।

- “আমার মাথার দিব্যি বৌমনি। সব সত্যি না বললে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে”।

বৌমনি এবার কেঁদে ফেললো।

- “আমি আর পারছিনারে মিষ্টি। আর পারছিনা। ওই শয়তান টা দিনের পর দিন আমার উপর শারীরিক মানসিক সব রকম অত্যাচার করে আসছে। বিয়ের পর দুই বছর সব ঠিক ছিল। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে এসব। আমার কাছে না আছে টাকা আর না আছে ফোন। মা বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে শয়তান টা পাশে দাঁড়িয়ে শোনে যাতে আমি ওদের কিছু বলতে না পারি। দাদা ও বিয়ের পরে বদলে গেল। কার কাছে যাবো? সেদিন লুকিয়ে মা কে বলতে গেছিলাম সব। শুনতে পেয়ে আমাকে কি মার টাই না মারলো। ল্যান্ড ফোনের তার টাও কেটে দিলো। তুই যেদিন এলি সেদিন। তোকে বললাম রান্না ঘরে পড়ে গেছি। ভেবেছিলাম পালিয়ে যাই। অনেক আশ্রম তো আছে যেখানে আমাদের মতো অত্যাচারিত সর্বহারা মেয়ে দের থাকতে দেয়। সেটাও হলোনা। আমাকে স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে এলো। রোজ চলে এই অত্যাচার। আমার কথা যাতে কেউ বিশ্বাস না করে তাই আমার নামে সারা পাড়ায় নানা বদনাম ছড়িয়েছে। কেউতো আমার সাথে কথাই বলেনা আমাকে বিশ্বাস করা তো দূর। আসার সময়ও আমাকে ভয় দেখালো যাতে কাউকে কিছু না বলি। আর জানিস সেদিন ফেসবুক শেখার অছিলায় তোর গায়ে হাত দিচ্ছিলো। আমি সহ্য করতে পারিনি। তাই তোকে বলেছিলাম চলে যেতে। সেদিনও আমাকে ........”

বলেই আবার কাঁদতে লাগলো বৌমনি। আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম। আমিও বুঝতে পারলামনা সেদিন বৌমনির হাতে কালশিটে দাগ দেখে। এটাও মাথায় এলোনা যে মেঝে তে পড়ে গিয়ে পায়ে বা কোমড়ে না লেগে হাতে লাগলো কীকরে। খুব কষ্ট হচ্ছিল এভাবে বৌমনিকে দেখে। আশে পাশে এত লোক দেখে চোখ মুছলাম। বৌমনি কেও শান্ত হতে বললাম।

- “তুমি দাদা কে এসব বলোনি কেন? দাদা তো তোমায় ভালোবাসে”।

- “ভালোবাসে? হাসালি রে মিষ্টি। বাসতো হয়তো। বিয়ের পরপর। এখন তো কোন এক অফিস কলিগের সাথে রাত কাটায়। তার কাছেই পরে থাকে। প্রায়দিন রাতে বাড়ি ফেরেনা। কই সে খবর তো কেউ রাখেনা। সবাই শুধু আমার দোষ দেখলো।”

- “পুলিশ এ জানাওনি কেন?”

- “আমাদের ওখানকার থানায় তোর কাকুর চেনা জানা। ওখানে বলে কিছু হবেনা”।

-“ আমি আমার মামা কে সব বলেছি। তুমি তো জানো আমার মামা পাশের থানার ওসি। মামা সব ব্যবস্থা নেবে বলেছে। মামা আমায় কতটা ভালোবাসে তুমিতো জানো। আমার কথা মামা সবসময় রাখে। মামা এখুনি চলে আসবে এখানে। চিন্তা নেই। নরমাল ড্রেসেই আসবে। ইউনিফর্ম এ আসবেনা ”।

- “এটা তুই কি করলি মিষ্টি?এবার যে সবাই জেনে যাবে সব কিছু। আমার কোনো মান সম্মান থাকবেনা। বদনাম হয়ে যাবে আমার। মরা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলনা আমার মিষ্টি”।

- “অলরেডি তোমার অনেক বদনাম হয়ে গেছে বৌমনি। আরেকটু নাহয় হলো। তাতে আর কি এমন ক্ষতি হবে। আর তুমি যেভাবে বেঁচে আছো সেটা কি মরা নয়? এভাবে অন্যায় সহ্য করতে থাকলে তুমিও কম অপরাধী হবেনা। যে অন্যায় করে আর যে অন্যায় সহ্য করে দু জনেই অপরাধী। আর কোনো কথা নয়। আমি যা বলবো সেই মতো কাজ করবে”।

- “আছা কিন্তু তুই এসব জানলি কীকরে?”

- “হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছে ছিল আমি সব জানি। তোমাকে বের করে আনি ওই নরক থেকে”।

বৌমনি কে সব টা খুলে বললাম।

- “আচ্ছা বৌমনি তুমি কার সাথে দেখা করতে গেছিলে তবে? সেটা তো মিথ্যে নয় কারণ মিলির মা তোমাকে দেখেছে”।

- “ও আমার দাদার বন্ধু। সেদিন বাজার করতে গিয়ে হঠাৎ ওর সাথে দেখা। আমায় খুব ভালোবাসতো জানিস। আমিও বাসতাম। কিন্তু তখন বেকার ছিল বলে মা বাবা আর দাদা ওর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলোনা। বেশ কয়েকদিন ওর সাথে দেখা হলো। জানতাম ও আমার জন্যই ইচ্ছে করে আসে । ওকে সেদিন সব বলছিলাম। ও বলেছিল পুলিশে খবর দেবে। আমিই না করেছিলাম। বলেছিলাম আমাকে না জানিয়ে ও যেন কিছু না করে। আর তখনই মিলির মা আমাদের দেখে ফেললো। সেই থেকে আমার বাইরে বেরোনো ও বন্ধ। আর কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। ওর সাথে অন্যায় করেছিলাম। ওর ভালোবাসার মর্যাদা দিয়ে সেদিন যদি ওর হাত ধরে বাড়ি ছাড়তাম তাহলে আজ এই শাস্তি ভোগ করতে হতোনা আমায়”।

আমার ও মনে পড়ে গেলো প্লাবনের কথা। ইশ এত কিছুর চক্করে তো ওর কথা একদম ই ভুলে গেছি। ফোন করতে বলেছিল আমায় সেটাও করা হয়নি। বৌমনিকে বললাম,

- “জানোতো বৌমনি আমিও একজন কে ভালোবেসে ফেলেছি”।

- “কে সে শুনি?”

- “আগে বলো তোমার সেই ভালোবাসার মানুষটি কে তবে আমারটা বলবো”।

- “ওর নাম প্লাবন। খুব ভালো ছেলে জানিস। একটা বড় ফার্মাসিউটিক্যালস এ ভালো পোস্টে কাজ করে। ও তোর কথা ও জানে”।

হঠাৎ আমার মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে । নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলামনা । আবার জিজ্ঞেস করলাম,

- “কী নাম বললে?”

- “প্লাবন রে”।

দল পাকানো কষ্ট টাকে ঢোক গিলে পেটে চালান করে দিয়ে মুখে হাসি টেনে বললাম,

- “আমি ওনাকে ফোন করবো এক্ষুণি”।

- “কিন্তু ফোন নম্বর যে আমার কাছে নেই”।

- “আমার কাছে আছে”।

- “তোর কাছে আছে? মানে?”

সব টা বললাম বৌমনি কে।

- “মিষ্টি তুই তো ক্ষণে ক্ষনে আমাকে চমক দিচ্ছিস”।

একটা শুকনো হাসি হেসে সেই বহুকাঙ্খিত নম্বর টা ডায়াল করলাম। সেই ফোন করলাম। তবে আমার ভালোবাসা হিসেবে নয় বৌমনির ভালোবাসা হিসেবে। দুঃখেও আমার হাসি পাচ্ছিলো। ফোন করলাম। প্লাবন বললো,

- “তোমার বৌমনির কথা বলবো বলেই তোমাকে ডেকেছিলাম। তোমার কথা ও আমাকে বলেছিলো যে একমাত্র তুমি ওকে ভালোবাসো। আর তাই বুঝেছিলাম যে তুমিই একমাত্র আমাদের হেল্প করতে পারো। রাস্তায় সেদিন তোমায় সব বলা নিরাপদ মনে হয়নি। তাই তোমায় বলেছিলাম ফোন করতে। প্লিজ মিষ্টি একটু হেল্প করো তোমার বৌমনি কে”।

- “আমি আমার বৌমনির জন্য সব করতে পারি। তোমাদের জন্য যা যা করতে হবে সব আমি করবো”।

মামা এলো। মামা যেমন যেমন বলে দিল তেমন ভাবে প্লাবন কে জানিয়ে রাখলাম। বৌমনিকে দিয়ে মামা কিসব কাগজে সই করালো। তারপর বৌমনি কিছুক্ষন কথা বললো প্লাবনের সাথে। কথা বলার সময় দেখলাম খুশি তে বৌমনির চোখ দুটো চিকচিক করছে। মনে মনে ভাবলাম, বৌমনির ভালোবাসা কে আমি নিজের ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছি। তবে প্লাবন যদি আমার প্রেম হয় তাহলে বৌমনি আমার সত্যিকারের ভালোবাসা। তাই প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যে ভালোবাসার ই জয় হলো। কিন্তু সবাই জানে আমার ক্যারেক্টার খুবই স্ট্রং। এত সহজে আমি প্রেমে পড়িনা। তাই প্লাবন বৌমনি কে ভালোবাসলেও আমি সারাজীবন প্লাবন কেই ভালোবাসবো। নাই বা হলো ও আমার। বৌমনি ফেরার পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

- “এই মিষ্টি তুই বল এবার তোর ভালোবাসার মানুষ টার নাম কী?”
আমি বললাম,
-“ বাঁধ”।

;;;;;;;;;;;;;;;;;;

আজ প্লাবন আর বৌমনির রিসেপশন। আমারতো বিয়ে থেকেই নিমন্ত্রণ। টুবাই দাদা আর বৌমনির ডিভোর্স টা মামা ছয় মাসের মধ্যেই করিয়ে দিয়েছিলো। কাকুর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের মামলা টা সাজিয়েছিলো মামা ই। বৌমনি অবশ্যই নানান তথ্য দিয়ে মামলা টা করেছিলো। রবীন কাকু আপাতত জামিনে ছাড়া পেয়েছে। মামা না থাকলে কিছুই এত ভালো ভাবে মিটত না। দাদা আর কাকু বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেছে কেউ জানেনা। জানতেও চায়নি কেউ। পাড়ার যে কাকিমা জেঠিমা রা কাকুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় প্রণাম করতো তারাই এখন ওই বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে কাকু কে শ খানেক শাপ শাপান্ত করে তবে যায়। আমার বৌমনি অবশ্য এই লড়াই জিতে গিয়ে গল্পের নায়িকা দের মতো আই পি এস অফিসার বা ডাক্তার হতে পারেনি। তবে আবার পড়াশোনাটা শুরু করেছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। আর প্লাবনের ছোট্ট দুকামরার ফ্ল্যাটে সাজিয়েছে নিজের স্বপ্নের সংসার।

আমি এখন বৌমনি আর প্লাবনের ফ্ল্যাটে। কাল ওদের রিসেপশন। তাই আমি আর প্লাবন ফ্ল্যাট টাকে সুন্দর করে সাজাচ্ছি। বৌমনি বললো,

- “জানিস মিষ্টি তোর প্লাবন দার একটা বন্ধু আছে। আবীর। তোকে খুব পছন্দ করে। যেদিন থেকে শুনেছে তোর সাহস আর বুদ্ধির জন্য আমরা আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই তোকে পছন্দ করে। একবার দেখবি নাকি ছেলেটাকে?”

- “হ্যাঁ মিষ্টি তোমার বৌমনি ঠিক বলেছে। আবীর খুব ভালো ছেলে। এই ফ্ল্যাট টার জন্য ও আমাকে এত গুলো টাকা ধার না দিলে কী যে করতাম। ও কাল আসবে। তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দেব ”।
আমার অবস্থা টা যদি ওরা বুঝতো!! আমি যে প্লাবন কেই ভালোবাসি। বৌমনি তুমিতো জানোনা তোমার জন্য কত বড়ো স্বার্থত্যাগ করেছি আমি। আবীর আসুক বা বাদুড়ে রং। কেউ আমার মন থেকে প্লাবন কে সরাতে পারবেনা। কারণ আমার ক্যারেক্টার খুবই ষ্ট্রং। এত সহজে আমি প্রেমে পড়িনা।

;;;;;;;;;;;;;;;;;-----
রিসেপশনে সবাই এসেছে। বৌমনির মা দাদা বৌদি, আমার মা বাবা মামা সবাই। কিন্তু ওই আবীর আসেনি বলে প্লাবন খুব চিন্তিত। হঠাৎ কেউ দরজায় নক করলো। প্লাবন দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হেলমেট পরেই চলে এসেছে। যতসব বেকার লোকজন। বৌমনি আর প্লাবন ওকে নিয়ে আসছে আমার সাথে আলাপ করানোর জন্য। আমি পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছিলাম। একটা সুন্দর গলার আওয়াজ পেলাম পিছন থেকে।

- “হাই মিষ্টি আমি আবীর”।

মুখ বেকিয়ে হ্যালো বলে পিছন ঘুরলাম । আবীর মাথা থেকে হেলমেট টা খুলে চুল গুলো ঠিক করলো। এই মুহূর্তে একজন সুপুরুষ দাঁড়িয়ে আমার সামনে। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা। ট্রিম করা চাপ দাঁড়ি। চোখে কি যেন একটা আছে যেটা দেখলে চোখ সরানো যায়না। যদিও আমার ক্যারেক্টার খুবই স্ট্রং। এত সহজে আমি প্রেমে পড়িনা।

আবীর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। আমার মনের আকাশ সেই হাসিতে আবীরের রঙে রাঙিয়ে গেছে ততক্ষনে। আমায় দেখে দেখি প্লাবন“দা” আর বৌমনি মুচকে মুচকে হাসছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। কে জানে এটা শ্রাবণ মাস নাকি ফাগুন... কি জানি ফুল ফুটেছে নাকি ফোটেনি.... শুধু আবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো,

“বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা, কারা যে ডাকিলো পিছে, বসন্ত এসে গেছে........”

সমাপ্ত

© FB.com/taniya.dutta.1671



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~