Bristi - A bengali story

Jolchobi

বৃষ্টি

চয়ন মজুমদার

দুর্গাপূজা তো প্রায় চলেই এলো । কিন্তু মা দুর্গার চরণ কি এই মোহনপুরী গ্রামের মাটিতে পড়বে না।এই চিন্তায় থাকে ওই গ্রামের মানুষগুলো। সবসময় ভয়ে সিধিয়ে থাকে, এই কার পালা এলো। এ যেন এক অভিশাপ। হ্যাঁ অভিশাপ ই তো বটে।হঠাৎ করে এই অভিশাপ যেন গ্রাস করলো হাসিখুশী মাখা গ্রামটাকে। নিষ্পাপ মানুষগুলো পড়লো বিপদে। কিন্তু কি বিপদ!!!!!! কেউ কোনোদিন জানতেও পারলো না আজপর্যন্ত যে গ্রামটাতে কোন অভিশাপ গ্রাস করলো। হঠাৎ করে খরা শুরু হলো। চাষবাস সব বন্ধ হয়ে গেল। দিনের বেলা প্রখর সূর্যের তাপ আর রাতের বেলা বিনা বৃষ্টিতে কালবৈশাখী ঝড়, মেঘ গর্জন এবং বজ্রপাতে।। কি অদ্ভুত আবহাওয়া। না এটা কোনো সাধারণ বিষয় হতেই পারে না। তারওপর আবার রাতে কেউ বাইরে গেলে বা মাঠে গেলে সে আর বাড়ি ফেরে না। এই ভাবে কত লোক উধাও হয়েছে। গ্রামের মানুষজন মিলে কত শান্তি সনস্থান করলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।গ্রামে এই অদ্ভুত ঘটনা যেন বেড়েই চললো। কিছুই করা যাচ্ছে না। ছোট্ট বৃস্টি কে নিয়ে ওর মা খুবই চিন্তিত থাকে। বৃস্টির বাবাকে ও বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না ঠিকমতো। কিন্তু গ্রামের মানুষ বাড়ির বাইরে না গেলে খাওয়া জুটবে না তো।। বৃস্টি কিন্তু খুব হাসিখুশি থাকে সবসময়।ও ওর মাকে বলে ," মা, চিন্তা করো কেন। ওই যে দুগ্গা আছে না ওই সব ঠিক করে দেবে গো। তুই চিন্তা করিসনি তো বাপু।" ওর মা চিন্তিত সুরে বলে ," তোর দুগ্গা কে তো আমরা সব সময় ডাকি রে, আমাদের এই অভাগা দের ডাক কি তোর দুগ্গা শুনতে পাই না।।" বৃস্টি কান্নার সুরে বলে," ও মা গো ।ও শুধু আমার দুগ্গা হতে যাবে কেন, ও কি তোদের দুগ্গা নয়। ও যে আমাদের সবার মা রে। আমাদের সবার মধ্যে ও আছে রে। ও ঠিক ই আসবে, ওকে আসতেই হবে রে" ।বৃস্টি এই রকম আজগুবি কথা বলেই থাকে, ওর মা তো জানেই এমনকি গ্রামের সব লোকই জানে যে খোকনের মেয়ে বৃস্টি একটু কেমন যেন!!!! অদ্ভুত মেয়ে। যদিও বাচ্ছা তো। যাইহোক বৃস্টির মা ওর এই কথাগুলো পাত্তা না দিয়ে ওর বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকে।।।।

তো গ্রামের এই দুর্দশায় কোনো সাধু সন্ন্যাসীর তাবিজ ও কোনো কাজে লাগেনি।সবাই ই যেন নিজেদের মৃত্যুর দিন গুনছে।। চারিদিকে শুধু হাহাকার।। এইভাবে কি শেষ হয়ে যাবে গ্রামটা আর গ্রামের মানুষগুলো। এই কি জীবন। হে মা দুর্গা ,মা গো, রক্ষা করো গো মা, রক্ষা করো মা।

বৃস্টির মা এই আলোচনা করতে করতে সন্ধ্যা হতেই জল নিয়ে বাড়ি চলে এলো। পাড়ার কুয়োতে সবাই সন্ধ্যা হলেই জল ভরে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। বাড়ি এসে দেখলো যে বৃস্টির বাবা বাড়ি ফেরেনি। বলেছিল যে সন্ধ্যা হতেই বাড়ি চলে আসবে। " কি রে মা, তোর বাবা এখনো বাড়ি এলো না তো রে" বৃস্টি কে উদ্দেশ্য করে বলে ওর মা। কিন্তু বৃস্টি যে ওর খেলনা ত্রিশূল টা নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত। ওর কোনো কথাই কানে গেল না যেন।। ও খেলতেই চললো। এরপর রাত বাড়তে লাগলো ।কিন্তু বৃস্টির বাবা ফিরছেই না। ওর মা তো চিন্তায় কেঁদেই ফেলেছে প্রায়।। দরজা বন্ধ করে দরজার কোনায় নীরব পাথর হয়ে বসে রয়েছে। রাত প্রায় 12টা বাজে। বৃস্টি ঘুম ঘুম চোখে ওর মা কে বলল," কি রে মা ভাত দিবি না। আজ সন্ধেতে তো দুগ্গা কে ও খেতে দিলি না রে। ভাত দে না মা, ক্ষিধে পেয়েছে রে।" বৃস্টির মা রেগে গিয়ে বলল," কি সর্বনাশী মেয়ে রে তুই। তোর বাবা ফিরলো না , ফিরবে কিনা তাও জানি না, আজ কি তাহলে ওর ............... কান্না থামিয়ে বৃস্টি কে গর্জে উঠে বললো," ........ আর তোর ভাত খাওয়া লেগেছে।।। যা আগে তোর বাবা কে খুঁজে নিয়ে আয় তারপর ভাত খাবি, যা যা।।।।।।" কথাটা শুনে বৃষ্টির মুখ টা যেন লাল হয়ে গেল। বৃস্টি ধীরে বললো," ঠিক আছে রে মা, আজ আমি তোর কাছে বাবাকে ফিরিয়েদিয়েই যাবো"। বলে বৃস্টি ওর ত্রিশূল টা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ওর মা আর ভয় পেয়ে বললো ,"একি বৃস্টি কোথায় যাচ্ছিস মা, ফিরে আই মা"। ততক্ষণে বৃস্টি দৌড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বৃস্টির মা বাইরে বেরিয়ে পাশের বাড়ির লক্ষণের বাবা আর কানাই কে সব ঘটনা খুলে বলে কাঁদতে কাঁদতে। যায় হোক কানাই বলে,"চলো বৌমা, বৃস্টি কোথায় গেছে আমরাও যাবো ওর সাথে। যদি মরি তো সবাই একসাথে মরবো।"পথে যেতে যেতে কানাই আর লক্ষণ অনেককেই জোগাড় করে ফেললো ওদের সাথে। ওরা হাক পারতে লাগলো," কে কোথায় আছিস রে, বৃস্টি ওর বাবাকে খুঁজতে গেছে, আমাদের ও যেতে হবে। অনেকেই ওদের সাথে লাঠি সোটা।ই দৌড়ে গেল। ইতিমধ্যেই বৃস্টি পৌঁছে গেছে ওদের গ্রামের শেষপ্রান্তে। এর পরই জঙ্গল। বাকি রাও বৃষ্টির পিছন পিছন ছুটে আসে আর দেখে দূরে জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। আর বৃস্টি ও দেখা গেল মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়েছে। সবাই বৃস্টির পিছনে পিছনে এসে ওদের যেন চক্কু চড়কগাছ। এ এ এ কিইই দেখছে ওরা!!!!!!!!!

এক মস্ত বটগাছের তলায় বসে আছে এক তান্ত্রিক। কি ভয়ার্ত মুখ তার। মুখ তার গোঁফ দাড়ি তে ভর্তি। কপাল ও গালে তার লাল রক্ত মাখানো সারা গায়ে তার লাল টকটকে রক্ত যেন রক্তনদী তে স্নান করেছে সে। চারিদিকে মানুষের মৃত দেহ ছড়ানো। কি বীভৎস!!!!!!! শেয়ালে খাচ্ছে টেনেটুনে। যজ্ঞ করেছে সে একমনে। বটগাছের ঝুড়ি নেমেছে আর তাতে ঝুলছে মুন্ডু কাটা একটা দেহ। আর রক্ত পড়ছে যজ্ঞ এর আগুনে। ওরা সবাই আর বেশি দূর এগোতে পারলো না। কানাই চিনতে পারলো যে ঝোলানো দেহ টা কেশবের যে দুদিন আগে রাতে মাঠে গিয়ে আর ফেরেনি। তান্ত্রিকের পাশে রাখা আছে বৃস্টির বাবার দেহ। যেন সে ঘুমোচ্ছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে, বোঝার উপায় নেই।।।।

বৃস্টি ইতিমধ্যেই তান্ত্রিকের সামনে গিয়ে বললো," তবে রে দুস্টু, ছেড়ে দে আমার বাবাকে।" কথাটা মনেহয় তান্ত্রিকের কানে পৌছালো না। সে আরো জোরে বলতে লাগলো। ইতিমধ্যে বৃস্টির মা দৌড়ে গিয়ে বৃস্টির কাছে চলে গেল।কিন্তু বাকিরা এক গাছের কোন লুকিয়েই আছে। এবার বৃস্টি ওর বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকতে লাগলো। বৃস্টির মা তো ভয়ে কাঁপছে। বাকিরাও চলে এলো বৃস্টির মার পিছনে। বৃস্টির হাতের ছোঁয়া লাগতেই ওর বাবার যেন জ্ঞান ফিরে এলো। ওর বাবা চোখ খুলে তাকালো। এবার যেন হটাৎ করেই তান্ত্রিকের চোখ খুলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তান্ত্রিক টা একটা তির ছুড়ে দিলো বৃস্টির দিকে। ক্ষনিকের আর্তনাদ। বৃস্টির প্রাণহীন দেহ তা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। হাত থেকে পড়ে গেল ত্রিশূল টা।যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা যেন সব নীরব দর্শক। কারোর মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। সবাই থর্থরিয়ে কাঁপছে। তান্ত্রিক অট্টহাসি দিয়ে বললো," হে, নরপিশাচ আজ আমি অমর হবই। তোকে আজ আমি বাকি পঞ্চাশ টা বলি সম্পর্ণ করবো । আয় নরপিশাচ সামনে আয় । এই নে রক্ত। এই সামনে আয়।।। তান্ত্রিক এবার পাশে থেকে একটা দেহ তুলে নিলো আর নিক্ষেপ করলো আগুনে। পৈচাশিক খেলায় মেতে উঠেছে সে। এবার সে তাকালো গ্রামের ওই মানুষ গুলোর দিকে আর হটাৎ করেই যেন বটগাছের শক্ত একটা ঝুড়ি আসে আপনি আপনিই বেঁধে ফেললো সবাই কে।বৃস্টির মা বৃস্টির দেহ টা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তান্ত্রিক আবার বলে উঠলো, সব কটাকে বলি দেব আজ। আই নরপিশাচ, গ্রহণ কর আমার আত্মা কে। করে দে অমর।।"এই বলে সে খড়্গ হাতে বৃস্টির মৃতদেহ ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলো মানুষগুলোর দিকে।।। আজ আর কারোর নিস্তার নেই। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। বাকিরা সামনে মৃত্যু দেখে নিজেদেরকে শেষবারের মতো বাঁচাবার চেষ্টা করছে।।।

কিছুদূর দিয়ে তান্ত্রিক তার পিছনে থেকে এক বাচ্ছার খিলখিল হাসি শুনতে পেল। পিছন ঘুরে দেখলো যে বৃস্টির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে । এ কে!!!!!!!! সামনে বৃস্টির মৃতদেহ পরে আছে, তাহলে এ কে?????
মেয়েটি বৃস্টির মৃতদেহের পাশ থেকে ত্রিশূল টা হাতে তুলে নিলো। হেসে হেসে তান্ত্রিক কে বললো," ওরে দুস্টু, আমি তো এবার চলে এসেছি রে আর তো তুই কাউকে মারতে পারবি না।" মার দেখি শয়তান।। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো তান্ত্রিক গর্জে উঠলো," কে তুই মেয়ে???" তোকে তো আমি মেরে বন্দি করে ফেলেছি!!! কে তুই!!!!"

মেয়েটি হেসে উঠল আরো। বললো,"আমাকে তুই কোনোদিনই বন্দি করতে পারবি না রে ।।" আমি সেই যে তোকে আজ আমি সব কষ্ট থেকে মুক্তি দেব রে তোকে অমরত্ব দান করবো। তান্ত্রিক গর্জে উঠে বললো, " তোকে আমি আবার মেরে ফেলবো, নরপিশাচ কে দান করবো তোর রক্ত!!!"
" তো আই দেখি!!!! কেমন পারিস!!" হেসেই চলে মেয়েটা। তান্ত্রিক খড়্গ নিয়ে দৌড়ে যায় মেয়েটার দিকে। কিন্তু বৃস্টির মৃতদেহ টা তে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একদম মেয়েটার পায়ের কাছে। মেয়েটা হেসে বলে," আজ যে তোর পাপের ঘরা পূর্ণ। তোকে তো এবার শাস্তি পেতেই হবে রে!!! তোকে শাস্তি আমি দেব না রে। তোকে তো এরা শাস্তি দেবে রে!! তুই যাদের এতদিন ধরে সর্বনাশ করেছিস লুকিয়ে লুকিয়ে" বলেই মেয়েটি তার হাতের ত্রিশূল বিঁধিয়ে দেয় তান্ত্রিকের কপালে। কপাল থেকে রক্ত ঝরে পড়ে তান্ত্রিকের। হাত পা যেন অসাড় হয়ে ওঠে তান্ত্রিক এর। সে যে তার সমস্ত পৈশাচিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে।

"রক্ষা কর নরপিশাচ!!!! আমার শক্তি ফিরিয়ে দে" বলে উঠতে চেষ্টা করেও সে উঠতে পারে না।।
। মেয়েটি হেসে বলে," তোর পাপের শাস্তি শুরু হলো রে শয়তান। আজ গ্রামের সবাই তোকে শাস্তি দেবে। আমি তোকে অমরত্বের অভিশাপ দিচ্ছি রে!!!!!! তুই অমর, তোর শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই মরবি না রে!!!"

চারিদিক নিস্তব্দ।।। শুধু তান্ত্রিকের গোঙানি সোনা যাচ্ছে ব্যাস। মেয়ে টি এবার বৃস্টির মার কাছে যায় আর বলে," তোকে বলেছিলাম না মা, আজ আমি বাবাকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো। কিন্তু আমি আর তোদের সাথে থাকতে পারলাম না রে। আমি সবসময় তোদের পাশেই তো আছি রে। তোদের আমি সবসময় রক্ষা করবো রে। আমি যে সেই যে সবসময় তোদের সবার মধ্যেই তো আমি আছি রে। তোরা তো সবাই আমার ই সৃষ্টি রে। তোদের মধ্যেই তো আমার বাস রে। "

"মা মা .......... তুই এইভাবে আমাদের মধ্যে ছিলি আমরা বুঝতে পারলাম না। না মা তুই আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবি না মা", ডুকরে কেঁদে ওঠে লক্ষণের বাবা।।

" এই পুরো পৃথিবীই তো আমি রে। আমি তো সবসময় তোদের সাথেই আছি, তোদের মধ্যেই আছি!!!!!!"

"তুই নিঃসন্তান হয়ে থাকবি না। তুই আবার মা হবি রে", বৃস্টির মা কে বলে মেয়েটি।। "এই গ্রামে সবাই আবার ফিরে আসবে যে যার ঘরে........"বলে মেয়েটি যেন কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে পড়ে।

আর বৃস্টির মৃতদেহের উপর একগাদা শিউলি ফুল এসে পড়ে।।।। সবার চোখে এ যেন সেই মুহূর্ত....

"মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতুবরদে নমোঃ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষ দেহি
মহিষাসুর- নির্ণশী ভক্তানংসুখদে নমোঃ
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষ দেহি।।।।।।"

শিউলি ফুল সরিয়ে দেখা গেল যে বৃস্টির দেহ টা আর নেই।।।।।।।।।।।।।।

সমাপ্ত

© FB.com/id=100022524007125



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~