Mayera Mitthey Kotha Bole - A bengali story

Jolchobi

মায়েরা মিথ্যে কথা বলে

অর্ণব কর

স্কুল থেকে ফিরেই তৃনা বাইরের ঘরে স্কুল ব্যাগটা রেখেই রান্না ঘরের দিকে দৌড়ে গেল। তার মা রিনা তখন মেয়ের টিফিন তৈরিতে বাস্ত। তৃনা একটা কথা বলার জন্য দৌড়ে গিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তেই, হাত ফস্কে গ্যাস ওভেনে চাপানো ফুটন্ত সুপের কড়াইটা থেকে গরম সুপ ছিটকে আসতেই রিনা এক ঝটকায় মেয়েকে ছিটকে দিয়ে প্রচন্ড জ্বালায় আর্তনাদ করে উঠল। কি হল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তৃনা দেখতে পেল তার মা মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে আর তার চারপাশ থেকে গরম ধোঁয়া বাষ্প হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষনে ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে, আর তাতেই সে ভিতর থেকে 'মা' বলে ডুকরে কেঁদে উঠল। সেই ডাক শুনে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়েই রিনা চোখ বুজল।
তৃনা একবার ভাবল বাবাকে এক্ষুনি একটা ফোন করা দরকার, কিন্তু না। বাবা এসে আসল কারণটা জানতে পারলেই তো তাকে পিটিয়েই ছাতু করে দেবে কারণ বাবা তো তার থেকেও মা কে একটু বেশিই ভালবাসে। তাই সে নিজেকে কোনোভাবে সামলে উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা পায়ে বাইরের ঘরে হেঁটে এসে দরজাটা খুলেই পাশের ফ্লাটের টুম্পা কাকিমার দরজায় খুব জোরে জোরে ধাক্কা দেয়। ঘুম জড়ানো চোখে টুম্পা কাকিমা উঠে এসে দরজা খুলে তৃনাকে দেখেই খুব অবাক হয়ে যায়। সে প্রশ্ন করে, "কি রে তৃনা কি হয়েছে? স্কুল থেকে এই মাত্র ফিরলি বুঝি? না রে, তোর মা আজ ঘরের চাবিটা আমাকে দিয়ে যায়নি তো। দেখ তোর মা আজ ঘরেই আছে। কি হল? কাঁদছিস কেন?"
তৃনা তাদের খোলা ফ্লাটের দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে আরো জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে। টুম্পা কাকিমা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে তৃনাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তারপর তৃনাকে একটু শান্ত করে প্রায় টানতে টানতে নিজেই রিনাদের ফ্লাটের ভিতর চলে আসে। তৃনাই তাকে রান্না ঘরে নিয়ে যায়। টুম্পা কাকিমা সেই দৃশ্য দেখে নিয়েই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, তারপর নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে নিজের ফ্লাটের দিকে দৌড়ে যায়। নিচের সিকিউরিটি আর দুজনকে ফোন করেই রিনার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। ততক্ষনে সিকিউরিটি আরো তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে এসেছে। বিছানা থেকে একটা চাদর নিয়ে কোনোরকমে রিনাকে রান্নাঘর থেকে বার করে খুব সাবধানে নিচে নিয়ে আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা হাসপাতালে পৌঁছে যায়।
দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় অবশেষে ডাক্তাররা রিনাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। আই সি ইউ তে দেওয়া হলেও যতক্ষণ না জ্ঞান ফিরছে ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে কাছে যেতে নিষেধ করা হয়। ইতিমধ্যে তুষার খবর পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছালে তৃনাকে দেখেই তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর মত কেঁদে ওঠে। বাবাকে কাছে পেয়ে তৃনাও হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ পরে দুজনেই একটু শান্ত হলে 'কি হয়েছে' জিজ্ঞেস করতেই তৃনা আবার কেঁদে ওঠে। এরই মধ্যে কখন যে পুলিশ এসে হাজির হয়েছে সেটা তারা বুঝতে পারেনি। পুলিশ অফিসার বাঁকা চোখে ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করতেই তৃনা আর থাকতে পারে না। ঘটনাটির জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে। তারপর যা যা ঘটেছিল সব সবই উগরে দেয়। সব শুনে যখন পুলিশ অফিসার তৃনা আর তার বাবাকে বলেন "আপনাদের এক্ষুনি একবার আমার সাথে থানায় যেতে হবে", তখনই তৃনা ভয়ে মা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কথায় বলে, ঠিক মত ডাকলে ভগবানও সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না, আর রিনা তো মা। মেয়ের কান্না শুনে তার চেতনা ফিরে আসে। হাতটা অল্প নাড়িয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তৃনা আর তুষারকে ভিতরে আসতে বলে। যদিও নার্স তার মনোবাসনায় বাঁধা দিলে রিনার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে কানের পাশে এসে পড়ে। নার্স একবার সেই দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে তৃনা আর তুষারকে ভিতরে আসতে বলে। তৃনা এক ছুটে ভিতরে এসে মায়ের চেহারা দেখেই একটু দূরেই থেমে যায়। তারপর ধীরপদে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সুন্দরী, ফর্সা রিনার মুখের চামড়া পুড়ে কালো হয়ে গেছে। হাতের কনুই থেকে অনেকটা মাংস পুড়ে কালো হয়ে ঝুলে পড়েছে। এই দৃশ্য দেখে তৃনা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে সামনের বেঞ্চে বসে দুইহাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পুলিশ অফিসার কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করতে রিনা বলে, "রান্না করতে গিয়ে অসাবধানতা বসত সুপের কড়াইটা তার উপর পড়ে যায় আর তা থেকেই এই অবস্থা হয়।"
বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে তুষার আর তৃনার হাত ধরে রিনা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তৃনা বুঝতে পারে, "মায়েরা মিথ্যে কথাও বলে।"

সমাপ্ত

© FB.com/arnab.kar.39



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~