Obyakto - A bengali story

Jolchobi

অব্যক্ত

সুচিতা ব্যানার্জি

ঘড়িতে তখন সকাল ১০ টা। কোন এক যাত্রীবাহী লোকাল ট্রেনে বসে, নিজের ২৫০ টাকার ব্যাগ টাকে কোন রকমে দুই হাতের মধ্যে দিয়ে বুকের সামনে রেখে ভিড় ঠেলে ট্রেনের হাতল গুলো কে ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর তেইশ এর এক যুবক। উপর থেকে ব্যাগ টাকে দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে কিচ্ছু নেই, কিন্তু সেই ব্যাগ টি আর যুবক টি ই শুধুমাত্র জানে যে তার শেষের চেনে রাখা ফাইলে আছে ছেলেটার ভবিষ্যৎ। ফাইলের প্রতিটি খাপে পড়ে আছে এত বছরের অর্জিত ফলাফল, যা দিয়ে আজকে আবার নিজের ভাগ্য নির্বাচন করার চেষ্টা করা হবে। শেষের আগের চেনে রয়েছে একটা খবরের কাগজ ;যেই কাগজ টির ওজন খুবজোর ১৫০ গ্রাম, কিন্তু সেই কয়েকশো গ্রামের ওজনের কাগজটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বাড়ির বড়ো ছেলের দায়িত্ব...। অসুস্থ বাবা আর মা এর জন্যে কিছু করে দেখানোর অদম্য প্রচেষ্টা বা বেকার ছেলের আর্তনাদ। খবরের কাগজ এর শেষ পাতা টিতে দেওয়া বিজ্ঞাপনটি তেই আটকিয়ে আছে যুবক টির ভবিষ্যৎ। তার আগের চেনে রয়েছে ছোট একটা জলের বোতল আর ক্রিম বিস্কুটের প্যাকেট। পাঁচ টাকার বিস্কুট আর জল খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া প্রতিটি মধ্যবিত্ত ই জানে খিদের সময় এর স্বাদ যেকোনো পিৎজা, বার্গার কেও নিমেষে হারিয়ে দেয়। ঠিক তার আগের চেনে পড়ে আছে মানিব্যাগটা। ১০ টাকার তিন চারটে নোট আর নতুন ১০০ টাকার একটা নোট -এই গুলি দিয়েই এখনো পুরো মাস টা চালাতে হবে; তাই সযত্নে মানিব্যাগটা ব্যাগের ভেতরে রাখা। ব্যাগটির পাশের ছোট পকেটে রয়েছে ট্রেনের টিকিট। না, প্রতিদিন টিকিট কেটে যাওয়া বিলাসিতা না হলেও মাঝে মধ্যে টিকিট কেটে দেশের নাগরিকতাবোধ টা ও সজাগ রাখার চেষ্টা আর কি। ভীড় আর চিন্তার কারণে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম টিকে মুছতে ব্যাগের বামদিকে পকেটে রাখা রুমাল টিকেই ভরসা করতে হয়; কিন্তু তারপর এর দুর্গন্ধ যুক্ত ঘেমো রুমাল টাকেও চুপচাপ সহ্য করে ব্যাগ টি।
গত তিনবছর ধরে যুবক টির সাথে থাকতে থাকতে তার অভ্যাস গুলিকে মানিয়ে নিয়েছে সে। কোল্ড ড্রিংক এর বোতল, প্রাক্তন দের দেওয়া গোলাপ বা চকোলেট এর প্যাকেট, বাড়ির থেকে লুকানো সিগারেট এর প্যাকেট দেশলাই, লাইটার; বা হয়তো লাইব্রেরি থেকে আনা 'কাকাবাবু সমগ্র' কিংবা 'আমি সুভাষ বলছি'- এই সব গুলো কে নিজের মধ্যেই রেখে দিয়ে এত বছর ধরে রয়েছে। ব্যাগটি হয়তো জানেও না কয়েকবছর বা কয়েকমাস পরে সে আর যুবকটির সাথেও থাকবেনা....।

যুবকটির হাতে একটি বেল্টের ঘড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষাতে স্টার মার্কস পাওয়ার জন্যে, তার বাবা ঘড়িটি কিনে দিয়েছিল। সাত বছর ধরে অতি যত্নের সাথে রেখেছে সে ঘড়িটা কে। যদিও এই সাত বছরে অনেক ঘড়ি ই যুবকটির হাতে এসে তার বর্তমান, প্রাক্তন, আর অপ্রেমিকার মতো অবস্থান করেছে। কিন্তু প্রথম প্রেম বলে ঘড়িটার উপর থেকে এখনো মায়া সরাতেই পারেনি। এর আগের প্রতিটি ইন্টারভিউ তেই সাঙ্গ হিসাবে সর্বদাই পাশে ছিল সে। হাতের অন্যান্য ব্রেসলেট গুলো যখন প্রতিদিন তার হাতে বসে নিজেদের রানীর মতো ভাবত, ঘড়িটি তখন অতি যত্ন তে দেওয়াল আলমারিতে ঘাপের মধ্যে বন্ধ থাকতো। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে আজ অব্দি, সকল গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময় তার ডাঁক পড়েছে। তখন ই সেই ব্রেসলেট গুলোকে মুখ ভেংচিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাসি হেসেছে মনে মনে। কিন্তু জড়বস্তুর হাসি বলে সেই হাসি কারোরই চোখে পড়েনি, বা হয়তো কেউ বোঝার ও চেষ্টা করেনি। পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ সবক্ষেত্রেই তার উপস্থিতির জন্যে সে যুবকটির চিন্তিত স্বভাবের সাথে পরিচিত হয়েগেছে। এই কুড়ি মিনিটের ট্রেন-যাত্রা তে মালিকের বারংবার তার দিকে তাকিয়ে সময় লক্ষ্য করা কে দেখে সেও হয়তো মনে মনে বলছে-'সব ভালোই হবে'!

নতুন ইস্ত্রি করা নীল রঙের শার্ট টি যুবকটির সবচেয়ে পছন্দের। এবছর পুজো তে টিউশনির টাকা জমিয়ে নিজের জন্যে এই শার্ট টিই কিনেছে। এর আগের তিনটে ইন্টারভিউ তে ও এই শার্ট তাই পরেছে। আলমারিতে বাকি শার্টের তলায় সব চেয়ে যত্নে এর ই অবস্থান। শার্ট টির অবস্থা সব চেয়ে ভালো হবার জন্যে অন্যান্য শার্ট গুলো ওকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার সাহস পায়না বললেই চলে। কিন্তু ওর সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই নিজেদের অহম কে জিতিয়েই যুবকটির নিত্যদিনের সঙ্গী হিসাবে চলে তারা। আজকে আবার আলমারির থেকে নীল শার্ট টির বের করা দেখে হয়তো তারা আবার বুঝতে পেরেছে কোন এক বিশেষ কাজে যুবকটি যাচ্ছে। সেখানে তাদের হয়তো প্রয়োজন ও নেই কিন্তু তা-ও, তারা-ও তাদের জড়বস্তুর মন থেকে যুবকের জন্যে শুভেচ্ছা ই বলছে। নীল শার্ট টি আজকের মতো এরকম দিন গুলির জন্যে প্রথম থেকেই প্রস্তুত থাকে এবং নিজের মন থেকে তার জন্যে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে যায়না।

যুবকটির নীল জিন্সের প্যান্ট টি প্রায় বছর দুয়েক আগের। মধ্যবিত্তের সম্বলের মধ্যে এই রকম জিন্স প্রায় প্রত্যেকের ই থাকে। এই একটা, জিন্স কে মাথাতে রেখেই বিয়ে বাড়ি থেকে শ্রাদ্ধ বাড়ি সবেতেই যাওয়া যায়। জিন্স টি নিত্যদিনের সঙ্গী তে পরিনত হয়ে অন্যান্য দের মতো বুঝতে ও পারেনা আজকের দিনের গুরুত্ব।

পিঠের ব্যাগ থেকে নীল জিন্স, সব জড়বস্তু বা নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু গুলো যখন মন থেকে যুবকটিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে যুবকটি হয়তো সেগুলো কে পাত্তা ও দিচ্ছে না। বা হয়তো বুঝতে পারছে কিম্বা চাইছেও না। তাদের অব্যক্ত মনের কথা গুলো যদি যুবকটি বুঝতে পারতো, তাহলেও হয়তো সেই জড়বস্ত গুলো ও তাদের নিত্যদিনের বন্ধুর প্রিয় বন্ধু হতে পারতো। কিন্তু এই সব যদির কথা না ভাবে, সেই জড়বস্তু গুলো নিজের কর্তব্যে অবিচল...।।

এভাবেই অব্যক্তরূপে আমাদের সাথে জড়িয়ে থাকে আমাদের দৈনন্দিন এর জড়বস্তু গুলি....!!


সমাপ্ত

© FB.com/suchita.banerjee.79



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~