Prottyakhito Golpo - A bengali story

Jolchobi

প্রত্যাখিত গল্প

অরণ্য সোম

প্রেমে পড়েছে সপ্তর্ষি, তাও খুব বাজে ভাবে, একদম মুখ থুবড়ে প্রেমে পড়েছে বলা চলে। তিরিশ বছর বয়েসে এরকম প্রেমে পড়া মোটেই ভালো কথা নয়, যাই হোক সপ্তর্ষি প্রেমে পড়েছে। সাধারণ এনাটমি বলে শরীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো হল হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি, কিন্তু আজকাল সপ্তর্ষি যেই ভাবে নিজের মোবাইল ফোনটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে সর্বক্ষণ তা দেখে যে কোন কারুর মনে হতে পারে মানব দেহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল মোবাইল ফোন। প্রেমে পড়েছে সপ্তর্ষি।

যার প্রেমে পড়েছে তাকে সপ্তর্ষি এখনও চোখে দেখেনি, কবে দেখবে, আদৌ কোন দিনও দেখতে পাবে কিনা তাও জানা নেই কিন্তু তাতে সপ্তর্ষির প্রেম বাঁধা পাচ্ছে না, সত্তরের দশকের বছর পনেরোর কিশোর যেরকম মগ্ন হয়ে আকশে, উঁচুতে, খুব উঁচুতে, অনেক উঁচুতে ঘুড়ি ওড়াত, সপ্তর্ষির প্রেমও উড়ে চলেছে। কি ভাবে প্রেমে পড়ল সেটাও একটা ব্যাপার কিন্তু, সপ্তর্ষি যেই ভাবে প্রেমে পড়েছে সেই ভাবে আজকাল অনেকেই প্রেমে পড়ে, তো একথা বলা যাবে না সপ্তর্ষির প্রেমে পড়ার ধরন গিনেস বুকে নাম পাবে, ইউনিক হল ওর প্রেমের পরিণতি। তবে পরের কথা পরে, আগের কথা আগে...

সপ্তর্ষি কবিতা লিখত, আর এটা তো একটা চিরন্তন সত্য যারা কবিতা লেখে তারা শেষ অব্দি কোন দিনও সুখী হয় না, তবে এই সত্য কথা সপ্তর্ষি মনে হয় জানত না, ও শুধু কবিতা লিখত। মনের কথা গুলোকে সুন্দর শব্দের জামা পড়িয়ে ফেসবুকে কবিতা দিতে ও বড্ড ভালোবাসত। তা এইভাবেই ওর দিব্যি চলছিল, কিন্তু ওই যে অনেক উঁচুতে আকাশে ওরে যে ঘুড়িটার কথা বলছিলাম তারও ওপরে অনেকটা আকাশ আছে, আর সেই আকাশে ভগবান ওরফে ঈশ্বর বলে একজন লোক থাকে, প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর লোক একটা, কোন মানুষের সুখ শান্তি বেশিদিন সহ্য করতে পারে না, সপ্তর্ষিরও পারল না।

কোন এক রবিবার সকাল, নীল আকাশ, এত নীল আর পরিস্কার যে দেখে মনে হবে যেন সার্ফ এক্সেল দিয়ে কেউ কেচেছে, রোদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে টাইপ আকাশ পুরো, আর বেলা অব্দি ঘুমিয়ে, বেশ একটা ফিল গুড আমেজ নিয়ে সপ্তর্ষি যেই ফেসবুকটা খুলল কদমতলায় কে তা দেখার জন্য, দেখতে পেল কে যেন ওকে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। যেই দেখল মেয়ে, তাও বেশ অন্যরকম আর সুন্দরী, সপ্তর্ষি ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, মানে এক কথায় একসেপ্ট করে নিল।

ঘণ্টা খানেক পর টুং করে একটা শব্দ, দেখল নতুন মেয়েটা লিখে পাঠিয়েছে হাই, সপ্তর্ষিও লিখল হেলো, এই ভাবে ওদের কথা শুরু হল...

আর এইখান থেকেই শেষের শুরুও হল...

-সপ্তর্ষি আমার না তোমার লেখা কবিতা বড্ড ভালো লাগে
-সত্যি?
-হ্যাঁ গো সত্যি
-কোথায় থাকো তুমি? কি কি করো? বাড়িতে আর কে কে আছে? নাকি শুধুই বিকেলে জল এলে বোতলে জল ভরো?
-হিহি, বেশ বললে তো, ও তুমি তো কবি, যখন তখন যেমন ইচ্ছা শব্দ দিয়ে আঁকো ছবি! আমি একজন গৃহবধূ, আর একজন অভিনেত্রীও
-যাহ, তাই কখনও হয়
-এমা তুমি জানো না অসুখী দাম্পত্যের আরেক নাম অভিনয়?
-আর বলো
-আর কি বলব, আর কি শুনবে? ব্যারথ প্রেমের সংখ্যা দেব, আস্তে ধিরে গুনবে? ভালোবাসার ব্যাঙ্কে যত বার আমানত রেখেছি ততবারই ঠকেছি... তবু কি বলোতো কবি, আমি বেহায়া, নাকি এরকমই জানি না, এত কিছুর পরেও খুব খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়, মনে হয় আস্ত গোটা একটা পাহাড় হয়ে গোটা আস্ত একটা সমভুমির দিগন্তরেখাকে ভালোবাসি, মনে হয় এখনও কাউকে এক আকাশ ভালোবাসি
-সত্যি কেউ কখনও এতটা ভালোবাসতে পারে? কোথা থেকে শিখলে এতটা ভালোবাসা?
-তোমার থেকে কবি তোমার থেকে, অনুভূতিগুলো অসম্পূর্ণ ছিল, তুমিই তো দিলে ভাষা...

সপ্তর্ষি প্রেমে পড়ল, কতটা প্রেমে পড়ল তা বুঝতে পারছেন তো? এইভাবে ওদের প্রেমের ক্যালেন্ডার একটু একটু করে এগোতে থাকল, দিন হল সপ্তাহ, সপ্তাহ হল মাস আর মাস হল বছর, তারপর পাহাড় থেকে এল একদিন খবর...
-সপ্তর্ষি আমি আসছি, আর ফোনে নয়, তোমার পাশে তোমার কাঁধে মাথা রেখে তোমাকে ভালোবাসছি
-সত্যি বলছ? বলো সত্যি সত্যি একদম সত্যি বলছ তো?
-সত্যি সত্যি সত্যি একদম তিন সত্যি, আসছে মাসের একুশ তারিখে আসব, তুমি আসবে তো আমাকে রিসিভ করতে? বলো চিনতে পারবে তো?
-ট্রেন কখন ঢুকবে বলো? আমি দুঘণ্টা আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকব...

সেদিনের কথা শেষ হওয়ার পর, সপ্তর্ষি দেওয়াল থেকে ক্যালেন্ডারটা খুলে নিয়ে, হাতের কড় গুনে হিসেব করে দেখল এখনও পুরো চল্লিশ দিন বাকি, স্বপ্নে ভাসতে শুরু করল সপ্তর্ষি, ওর মনের অরন্যেতখন মুঠো মুঠো প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, উরে বেড়াচ্ছে, প্রজাপতিগুলোর ডানায় রঙ আর বসন্ত শুধু, আর তাতে রোদ আর পাহাড়ি ভালোবাসার গন্ধ, সপ্তর্ষি অপেক্ষা করা শুরু করল।

তারপর চল্লিশ কোটি বছর পর চল্লিশ দিন এল অবশেষে। সেই দিন কথা মত সময়ের আগে গিয়ে সেজে গুজে সপ্তর্ষি দাঁড়িয়ে থাকল প্ল্যাটফর্মে, কিন্তু ভালোবাসা তো এল না, সপ্তর্ষি ফোন করল, নাম্বারটা লাগল না, ফেসবুকে খুঁজল, কিন্তু দেখাল কনটেন্ট নট এভেলেবল, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সপ্তর্ষির মনে হল আকাশটা যেন কাঁচের তৈরি, ভেঙে ওর গায়ে পড়ছে, আর ধারালো কাঁচে সব কেটে ছড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সপ্তর্ষি দাঁড়িয়ে থাকল। দুপুর বিকেল হল, বিকেল হল সন্ধ্যা, সন্ধ্যা হল রাত কেউ এসে ধরল না অপেক্ষারত কবির নিঃসঙ্গ ওই হাত। কিন্তু সপ্তর্ষি ভেঙে পড়ার ছেলে না, ও দাঁড়িয়েই থাকল আর মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকল
-আসবে তো আসবে পরের ট্রেনেই আসবে, বলতেই থাকল সপ্তর্ষি বিড়বিড় করে। বাড়িতে না ফিরে, কিচ্ছু না খেয়ে দেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সপ্তর্ষি। পাক্কা তিন দিন পর সপ্তর্ষির বাড়ির লোক ওকে খুঁজতে খুঁজতে পেল রেল প্ল্যাটফর্মে। তারপর ওকে অনেক জোর করে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে নিয়ে আসা হল বাড়িতে।

কিন্তু আর আগের মত থাকল না, ও আর বাড়িতেই থাকল না, ওকে দিয়ে দেওয়া হল অন্তরাতে, একটা রি হ্যাবে, ও আর সুস্থ নেই, পাগল হয়ে গেছে। দামি দামি ডাক্তাররা ভারি ভারি ওষুধ দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু ও সব সময় বিড়বিড় করে কি একটা বলে, কেউ যদি এখনও ওর খুব কাছে গিয়ে ওকে শোনার চেষ্টা করে, বোঝার চেষ্টা করে তাহলে শুনতে পাবে
-আসবে তো আসবে পরের ট্রেনেই আসবে...

সমাপ্ত

© FB.com/aranya.som.161



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~