Swadhinota - A bengali story

Jolchobi

স্বাধীনতা

কেয়া রায়

১)

---- না বাবু । ছয় আঁটি ব্রাহ্মী শাক তিরিশ ট্যাকার কমে হবেনি।

----- বলিস কি!! পাঁচ টাকা আঁটি!! কুড়ি টাকা দিচ্ছি । দিয়ে দে। পাতাগুলোও তো শুঁটকো ।

----- কোতায় শুঁটকোপানা দেকলে!! আজ সকালেই শানপুকুর পার থেকে তুলি আনলাম। কত ডাঁটো পানা শাক। খোকাবাবুকে ভেজি খাওয়াও গিয়ে। দেকবে কেমন বুদ্ধি খুলবে।

--- কুড়ি টাকায় দিবি তো দে বুড়ি । নয় তো এই চললাম ।

----- শুন গ। না তোমার না আমার । পঁচিশটা ট্যাকা দাও দিনি।

----কুড়ি টাকার এক পয়সা বেশী দেব না । টাকা মাগনা নাকি!! গাছে ফলে?? পুকুর থেকে শাক তুলতে কি তোর পয়সা লাগে??

সনকা আর কথা না বাড়িয়ে শাক'কটা সুধীরবাবুর বাজারের থলেতে ঢুকিয়ে দেয়। তার তোবড়ানো গালদুটো শক্ত হয়ে যায়। মনে মনে গজরায়। আমার কষ্ট তুমি বুঝবে না বাবু। রাত থাকতে উঠে পুকুরে নেমে ভিজেপুড়ে শাক তুলে, সেই শাক বেছে, আঁটি বেঁধে বাজারে বসা-- কম ঝক্কি!! কাগজ বিছিয়ে বসে শাক বেচার জন্যে আবার বিশ টাকা 'তোলা' দিতে হয় ক্লাবের ছেলেদের। রাগে ফোঁপানি উঠে আসে সনকার বুকের ভেতর থেকে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ঐ তো একটু আগে পাঁচশো টাকা কেজি দরে অত বড় জিওল কাতল মাছটা কিনলে বাবু। কৈ সেখানে তো দর দস্তুর করলে না! এই গরীব বুড়ির দু টাকার শাক পাতায় যত কঞ্জুসী!! তুমি সরকারের ঘরে মোটা মাসমাইনে পাও। আর আমি যে কতদিন মাছের আঁশটাও চাখি না!
বলে না। সনকা কিছুই বলে না। খদ্দের লক্ষ্মী । বলতে নেই। বলে লাভও নেই।

২)

সেদিনের হপ্তাখানেক পর সনকা আজ আবার শাকপাতা নিয়ে বাজারে বসেছে। ছেলে খেদানো মেয়ে তাড়ানো বিধবা মানুষ সে। ছেলে বাচ্চু বিয়ের পর ঘরদোর কেড়ে মাকে মেরেধরে রাস্তায় বের করে দিয়েছে। মেয়ে সালু নিজের স্বামী শাউরী নিয়ে জেরবার। মাকে ভাত দেবার জো নেই তার। তাই এখন সনকার ঠিকানা হাবরার বেড়াবেড়ী গ্রামের পুরোনো প্রাইমারী স্কুলের প্রায় ভেঙে পড়া ঘর। আর পেট চলে পুকুর থেকে শাকপাতা, কচুঘেচু তুলে এনে বাজারে বিক্রি করে।
গত এক হপ্তা খুব বাদলা নেমেছিল। আকাশভাঙা বৃষ্টি। সনকা ইস্কুলবাড়ির বাইরে বেরোতেই পারেনি। তাছাড়া বর্ষাকালে শাকে পোকা হয় বলে লোকে শাকপাতা খেতেও চায় না। বুড়ির শরীরও ভালো ছিল না। ঘুষঘুষে জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। একমাত্র সঙ্গী ছিল পোষ্য ভোলা। ভোলাটা বড় ন্যাওটা। সারাদিন এপাড়া ওপাড়া চষে খায়। রাত হলে সনকার ডেরায় হাজির হয়। পায়ের কাছে কুঁইকুঁই করে, আদর চায়। সনকার নাতিনাতনির জন্যে জমানো আদরের ভাগটা ভোলাই পায়। সনকা রাতে যা খায়, ভোলা তার ভাগ পায়। গত হপ্তাভর মুড়ি বাতাসা খেয়েই কেটেছে। ভোলা ভাত শাক মুড়ি শশা সব খায়। লক্ষ্মী ছেলে সে।

৩)

আজ দেশের মুক্তির দিন। স্বাধীনতা দিবস। ইস্কুল বাড়ির দোরগোড়া না ডিঙ্গোনো সনকা আজকের দিনের মর্ম বিশেষ বোঝে না। তবে ঝকঝকে দিন দেখে আর সাতসকালে ইস্কুলে ঝান্ডা ওড়ানো দেখে সে কষ্টেসৃষ্টে গতর নাড়িয়ে ইস্কুল বাড়ির পিছন থেকে নিজের হাতে বোনা কটা কাঁচা হলুদ, কচুর শাক আর পুঁইডাঁটা তুলে ঝুড়ি মাথায় বাজারে চলল। মূর্খ বুড়িও বুঝেছে আজ আপিস ছুটির দিন, বাজারে বিক্রিবাটা ভালো হবে। চল্লিশ টাকার খরিদ্দারী হলে আজ চাল কিনে দুটো গরম ভাত রাঁধবে। কত্তোদিন ভাত খায়নি! ভাতের বাস বুক ভরে নেবে আজ।

প্রায় তিরিশ টাকা বেচাকেনা হয়েছে এই সময়ে সনকা দেখল সাদা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবী পরে সুধীরবাবু রিকশা থেকে বাজারে নামলেন। প্রথমেই মাছের দোকান থেকে সেরা ইলিশ নিলেন কেজিখানেক। তারপর পাঁঠার মাংস নিলেন দেড় কিলো। তারপরই সুধীরবাবুর চোখ পড়ল সনকার ঝুড়ির দিকে। সুধীরবাবু আবার গাছগাছালির ভেষজ গুণের ভক্ত। পায়ে পায়ে ঠিক হাজির।

----- ঐ বুড়ি, কাঁচা হলুদের কত দাম ??

---- কুড়ি ট্যাকা 'শ।

---- অ্যাঁ!!! বলে কি! পাগল নাকি! দশ টাকা দেব। হলুদ কটা দে।

----- হবে নি বাবু। দামে পোষাবে নি। দুশো গ্রাম আছে। পুরো চল্লিশ ট্যাকা লাগবে।

---- পনের টাকা দিচ্ছি। গা জোয়ারি করিস না।

---- পথ মাপো দিকি। আমার হলুদ আমি বেচবুনি। যাও।

------ এত বড় সাহস! বাজারে বসে "বেচব না" বলা যায় না। খদ্দের ফেরানো যায় না। জোচ্চোর!!

---- কারে জোচ্চোর বলছ!!!অ্যাঁ? আমার ইচ্ছে আমি বেচবনি। কার কি তাতে!

---- বেশ, হলুদ কটার দাম দিলাম সত্তর টাকা। নিতি হয় নাও নয়তো সরে যাও। অন্য খদ্দের আসতি দাও দেখি।

দুজনের গলা উত্তরোত্তর বাড়ছিল। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকবৃন্দ গোল হয়ে ক্যাচাল দেখে ফ্রিতে মজা নিতে লাগল।

লোকজনের সামনে অপমানিত হয়ে সুধীরবাবু হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বুড়ির ঝুড়ি উল্টে হলুদ কটা জোর করে কেড়ে নিতে গেলেন। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে এসে সুধীরবাবুর ওপর লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভোলা। তার পা কামড়ে ফেলে দিয়ে ধুতি পাঞ্জাবী ছিঁড়েখুড়ে দফারফা করে দিল। সুধীরবাবু পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগলেন। তবু কেউ তাকে বাঁচাতে এগোল না। ভোলা হঠাৎ মাছমাংসের গন্ধ শুঁকে সুধীরবাবুকে ছেড়ে তার থলের কাঁচা মাছ মাংসের প্যাকেট মুখে নিয়ে রাজীবপুর বাঁশবাগানের দিকে ছুটতে লাগল। তার সঙ্গে যোগ দিল আরো কতগুলো নেড়ি । আজ ওদের মহাভোজ। কোথা থেকে ছুটে এসে হাজির হল এক ঝলক দমকা হাওয়াও ওদের পিছুপিছু। সেই হাওয়ায় তেরঙ্গা পতাকাটা পতপত করে উড়তে লাগলো।

সমাপ্ত

© FB.com/keya.roy.980967



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~