Valobasa - A bengali story

Jolchobi

ভালোবাসা

শ্যামল মজুমদার

দরজাটা বন্ধ করে ধপাস করে বসে পড়লো সায়ন্তিকা । মাথা কাজ করছে না । বাবা যে এমন একটা ডিসিশন নিয়ে রেখেছে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি সে । অথচ কদিন আগেও বাবার সাথে সিমলা বেড়িয়ে এসেছে , নিরালায় কত কথা আলোচনা হয়েছে বাবা মেয়ের , বাবা একবারও অভিষেকের প্রসংগঃ তোলেনি । আজ এই বার্থডে পার্টি তে এরকম কিছু যে হবে তাও বোঝা যায়নি । এখনও নিচে বিলিতি স্কচের ফোয়ারা উঠছে । চন্দন কাকু আনন্দে জড়িয়ে ধরছেন এক একবার সঞ্জয় রায় কে । সায়ন্তিকার তেইশ তম জন্মদিন উপলক্ষে সামান্য একটা বার্থ ডে পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল , শুধু মাত্র বাবার কোম্পানির স্টাফ , কাকু জেঠুর বাড়ির লোকজন আর সায়ন্তিকার ক্লোজ কয়েকজন বন্ধু কে ইনভাইট করা হয়েছিল । পার্টির যখন জমে উঠেছে হঠাৎ সঞ্জয় বাবু তাঁর দীর্ঘদিনের কলেজ লাইফের বন্ধু তথা সেন পন্ডিত গ্রুপের চেয়ারম্যান চন্দন ব্যানার্জীকে কাছে ডেকে নিয়ে ঘোষনা করলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে সায়ন্তিকার সাথে চন্দন বাবুর ছেলে অভিষেকের বিয়ের কথা । সামনের মাসেই এনগেজমেন্ট হবে । প্রথম টা সায়ন্তিকা নিজের কানকেও বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি , ভাবলো বাবা আনন্দে একটু বেশি ড্রিংক করে বকছে । না তার ভুল ভাঙ্গলো , এক এক করে আত্মীয় স্বজন রা এসে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করলো তখন , তারপর যে কিভাবে সময় কেটে গেছে সে নিজেই জানেনা । নিমন্ত্রিতরা একে একে উপহার সামগ্রী দিয়ে গেছে , সে ছুঁয়ে ও দেখেনি , কোন রকমে একটু ভিড় টা হালকা হতে ছুটে নিজের রুমে চলে এসেছে । অভিষেকের সাথে অনেক দিনের পরিচয় , নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে । সুদর্শন স্মার্ট সিঙ্গাপুর থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে আসা ছেলে , এখন বাবার কোম্পানিতেই জোনাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে । অপছন্দ করার কারন নেই । ফোন টা বিপ বিপ করে উঠলো , চেয়ে দেখলো সন্দীপের মেসেজ । সে স্কিপ করে দিল মেসেজ টা । আচ্ছা , সন্দীপকে এখন যদি সে বলে অভিষেকের সাথে বিয়ে হবে আগামী মাসে , তাহলে সন্দীপের কি রিঅ্যাকশন হবে ? নির্ঘাত সুইসাইড করবে , বড্ড অভিমানী ছেলে , ভাবতেই সায়ন্তিকার বুকের ভেতর টা শীতল স্রোত বয়ে গেল ।

সন্দীপের বুক টা আজকাল হালকা ব্যথা করে মাঝেমধ্যে । এটা কাউকে বলেনি , একমাত্র সায়ন্তিকা কে সে সব কিছু খুলে বলতে পারে । বাবা মারা যাওয়ার পর একাকী সংসারের হাল ধরতে গিয়ে নিজের দিকে খেয়ালই দেওয়া হয়নি । মায়ের অসুখ নিজের পড়াশোনা সবকিছু মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা , তার মধ্যেই বুকে একটা টিউমার হয়েছে ভিতরের দিকে ডানপাশে । একবার এক ডাক্তার কে দেখিয়েছিল , সব কিছু পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন এটা লাইপোমা ।ভয়ের কিছু নেই , অপারেশন করিয়ে নিতে হবে নাহলে পরবর্তীকালে এটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে । কোথায় পাবে চল্লিশ হাজার টাকা ?অবশ্য সায়ন্তিকা অনেক বার বলেছে অপারেশন করিয়ে নিতে , সে দেবে । সায়ন্তিকার কথা মনে আসতে মনে পড়লো সেদিন রাতে বলছিল তার বিয়ে দিতে চায় তার বাবা । পাত্র নাকি রেডি বিয়ের জন্য , তার বাবার বন্ধুর ছেলে সিঙ্গাপুর থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে এসেছে । হেসে উঠলো সন্দীপ নিজের অজান্তেই , কোথায় সিঙ্গাপুরের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পাস করা ছেলে আর কোথায় পশ্চিম মেদিনী পুরের সাধারন বি এস সি পাস টিউশন করে দিন কাটানো ছেলে । সে আজও অবাক হয়ে যায় কি করে সম্পর্ক টা এতদূর আসলো !
হঠাৎ করেই ফেসবুক করতে করতে সুন্দর একটা ডিপি দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট , সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট , টুকটাক মামুলি কথা বার্তা , এই ভাবে মাস খানেক যাওয়ার পর প্রেম নিবেদন । তারপর গঙ্গা নদী দিয়ে কত জল বয়ে গেছে । তারপর ফোন নাম্বার আদান প্রদান । দুজনে দেখা ও করেছে। সায়ন্তিকা তার নিজের ফেরারীতে করে ইকো পার্ক, নিউ টাউন , সায়েন্স সিটি স্প্রিং ক্লাব ঘুরিয়েছে । সব শেষে ব্যারাক পুরে দাদা বৌদির বিরিয়ানি খেয়ে রাতের ট্রেনে সন্দীপ বাড়ি ফিরে এসেছে ।

নির্দিষ্ট দিনে এনগেজমেন্ট হয়েগেল । সবাই খুশি । সায়ন্তিকা মায়ের বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল । টানা টানা লম্বা চোখ । মায়ের ছবি দেখে প্রথম দিনেই সন্দীপ বলেছিল সে পুরো তার মায়ের মতো দেখতে । অবশ্য সন্দীপ নয় সবাই বলে মায়ের মুখের সাথে সায়ন্তিকার মুখের হুবহু মিল । মা কে খুব একটা মনে নেই । সেই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় মায়ের অসুখ ধরা পড়লো তারপর দেখলো মা একদিন সবাই সাদা ফুলে সাজানো গাড়িতে তুলে দিচ্ছে । বড় হয়ে শুনেছে মায়ের কন্ঠনালী তে ক্যান্সার হয়েছিল । কিন্ত সে কোনদিনই মায়ের অভাব অনুভব করেনি । বাবা নিজের হাতেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে , একবার কাকিমা বলেছিল মা মারা যাওয়ার সময় বাবার বয়স ছিল মাত্র আটত্রিশ বছর । সুপুরুষ বাবা ইচ্ছে করলেই বিয়ে করতে পারতো , শুধু সায়ন্তিকার কথা ভেবে বিয়ে করেনি । অথচ বাবা কি হ্যান্ডসাম দেখতে । সায়ন্তিকার এক একবার মনে হয় ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি তে , আর গায়ে একটা ব্লেজার চাপিয়ে দিলে বাবার চেয়ে হ্যান্ডসাম পুরুষ আর একটাও নেই । বাবা মায়ের প্রেম করে বিয়ে , মা কে এতো ভালোবাসতো আর দ্বিতীয় বার বিয়েই করলো না বাবা । অভিষেকের আসার কথা আছে । সিটি সেন্টারে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিবে । না:,এখনো ফোন ব্যাক করলো না সন্দীপ । তাকে একবার কলকাতা আনতে হবে , বিয়ের আগে অনেক কাজ করার আছে । সন্দীপের কথা বাবা কে বলেছিল সায়ন্তিকা । সব শুনে আশ্চর্যজনক ভাবে বাবা প্রথম টা চুপ করে থাকলো কয়েক মিনিট । তারপর বললো ,জীবন টা হিন্দি সিনেমা নয় , বড়লোক বাবার মেয়ে পালিয়ে গিয়ে গরীব একটা ছেলে কে বিয়ে করবে আর কুঁড়ে ঘর বানিয়ে দুজনে বাস করবে । টিউশন করে ছেলে টা মাসে নয় -দশ হাজার টাকা রোজগার করে আর তোমার মাসে হাত খরচ ত্রিশ হাজার টাকা । অভিষেক কেই বিয়ে করতে হবে ।
সায়ন্তিকা নীরব থেকেছিল । বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বড্ড ভয় পায় । সত্যি তো জীবন টা হিন্দি সিনেমা নয় । সকালে ঘুম থেকে উঠেই কর্নফ্লেক্স ট্রপিকানা স্যান্ডউইচ খায় । একদিন সন্দীপ কে জিজ্ঞেস করলো সে কি খেয়েছে ?সন্দীপ বলেছিল পান্তা খেয়েছে । হোয়াট ইজ পান্তা ? ইজ দিস টেস্টি ? পরে পদ্ধতি তা জেনে গরম ভাতে জল ঢেলে খেতে গেছিল ,না পুরো টা খেতে পারেনি , তার আগেই বমি করে ফেলেছিল সায়ন্তিকা । বাইরে গাড়ির আওয়াজ । হুম , অভিষেক চলে এসেছে , সে উঠে দাঁড়ালো । না যেতে হবে । বিয়ের আগে দুজন দুজনকে ভালকরে চিনে নিক জেনে নিক ।

বিয়ের দিন ফিক্সড হয়ে গেল । কদিন পরেই বিয়ে । সব কেনাকাটা চলছে । সায়ন্তিকা তার ফেরারী নিয়ে বেরিয়ে আসলো , হাওড়া স্টেশন যাবে , আজ সন্দীপ আসবে । সায়ন্তিকা এখনও সন্দীপ কে বলতে পারেনি তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। না বলবে না । জানতে পারলে হয়তো ট্রেন লাইনে শুয়ে পড়বে । অদ্ভুত পাগল ছেলে। সায়ন্তিকা তার সহজ সরলতা কে খুব ভালোবাসে । কলকাতার ছেলে গুলোর মতো হাম বড়া ভাব নেই । প্রথম দিনেই স্বীকার করেছিল সামান্য টিউশনি করে দিন কাটে তার । প্রথম প্রথম কথা বলতে হিমশিম খেয়ে যেত সায়ন্তিকা । ছোটো থেকেই কনভেন্ট স্কুলে পড়েছে ভালো বাংলা পারতো না , সন্দীপ বলতো যারা নিজের মাতৃ ভাষা কে ভুলে যায় তারা সবাই কে ভুলতে পারে । একবার একটা বাংলা ডিকশনারি ও কিনেছিল কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকে । স্টেশনে পৌঁছে দেখলো সন্দীপ বড় ঘড়ি টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সন্দীপ নিজেও জানেনা কেন সায়ন্তিকা ডেকেছে । কদিন ধরেই সন্দীপ কে সায়ন্তিকা বলছে কলকাতা আসতে । খুব নাকি দরকার আছে । ফোনে বলা সম্ভব নয় । সন্দীপ আজও বুঝতে পারেনা মেয়ে টাকে । একবার ঝগড়া লেগেছিল দুজনের , সন্দীপ বলেছিল ছিটাল মেয়ে । সত্যি পাগলামি তে ভরা মেয়ে । সন্দীপ গাড়ি তে বসতেই গাড়ি হাও ড়া ব্রিজ পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট হয়ে সোজা বাইপাসের দিকে এগিয়ে চললো । উইন্ডস্ক্রিনে চোখ রেখে সায়ন্তিকা বললো , "তোমার খিদা লেগেছে ?"
সন্দীপ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল , মুখ না তুলেই বললো ,"হ্যাঁ , সেই ভোরবেলা বেরিয়ে এসেছি , স্টেশনে চা বিস্কিট খেয়েছি "-,
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করলো সায়ন্তিকা । সন্দীপখাবার টেবিলে অবাক হয়ে দেখলো সায়ন্তিকার প্রিয় বিরিয়ানি আজ মেনুতে নেই । তার বদলে টিপিক্যাল বাংঙালি খাবার সুক্তো ডাল ইলিশ মাছের পাতুরি যা বরাবর সন্দীপের প্রিয় । সন্দীপ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো , "কি ব্যাপার ?বিরিয়ানি নেই আজ ?"
হাল্কা হেসে সায়ন্তিকা বললো , "সব বার আমার প্রিয় বিরিয়ানি তোমাকে খাওয়াই আজ তোমার পছন্দের ভাত ডাল না হয় খাই "।
সন্দীপ কোন কথা না বলে খেতে শুরু করলো ।

সন্দীপ ঘুমিয়ে আছে । এখন ঘন্টা দুই ঘুম ভাঙবে না । ঘুমন্ত সন্দীপের কপালে একটা চুমু দিল সায়ন্তিকা । এক ফোঁটা গরম জল পড়লো সন্দীপের কপালে । না , সময় নষ্ট করলে চলবে না । উঠে দাঁড়ালো সায়ন্তিকা , চোখ মুখ মুছে বাইরে রিসেপশনে এসে বিল মেটালো । খাওয়ার পর সায়ন্তিকা বাইপাসের ধারে এই নার্সিং হোমে এসে সন্দীপ কে যেই বলে তার বুকের টিউমারটার অপারেশন হবে , সন্দীপ কোন ভাবেই রাজি হয়নি । কারন বাড়িতে মা আছে ওকে জানানো হয়নি তাছাড়া নিজে টাকা পয়সা ও নিয়ে আসেনি , সায়ন্তিকার টাকায় কেন অপারেশন করবে ?অনেক ক্ষন তর্কাতর্কির পর , রেগে সায়ন্তিকা বলেছিল , নিজের টাকায় যদি অপারেশন করবে তাহলে এতদিন কেন করেনি ?সন্দীপ চুপ করে গেছিল । কারন এতগুলো টাকা একসাথে ম্যানেজ করা কঠিন , অনেক রকম কথা কাটাকাটি তারপরে অনেক রকম বুঝিয়ে সন্দীপ কে শান্ত করেছিল সে । তারপর ডাক্তার বললেন , দুদিন রেস্টের পর সন্দীপ বাড়ি যেতে পারবে এখানে থাকার দরকার নেই । সায়ন্তিকা আগে থেকে সব ব্যাবস্থা করে রেখেছিল । সন্দীপ রাজি হতেই এক ঘন্টার মধ্যে ব্লাড রিপোর্ট ইসি জি রিপোর্ট রেডি করে অপারেশন শুরু ।যাক , এতদিনে একটা বোঝা নামলো বুক থেকে । অন্তত মানুষ টা ভালো থাকুক । হয়তো আর কোনদিন দেখা হবেনা কথা হবেনা । জ্ঞান ফিরলে হয়তো খুঁজবে সায়ন্তিকা কে। নার্সিং হোমে এক্সট্রা টাকা দিয়ে এসেছে সায়ন্তিকা । ওরা দুদিন পর ওকে গাড়ি তে করে ছেড়ে দিয়ে আসবে । হঠাৎ মনে পড়তে দেখলো ফোনটা । দুটো মিসদ কল অভিষেকের । অঞ্জলি জুয়েলার্সে আজ অভিষেকের সাথে গয়না কিনতে যাওয়ার কথা । সে ফোন টা অন করে প্রথমে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট টা ডিঅ্যাকটিভেট করলো । তারপর হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বার টা ব্লক করলো । তারপর ব্যাটারি খুলে সিম টা খুলে ফেলে দিল । নতুন একটা সিম লাগিয়ে অভিষেককে মিস কল করলো । তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল ।

সমাপ্ত

© FB.com/shyamal.majumder.39501



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~